ফের ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু–আতঙ্ক। কম বয়সীদের নিয়েই বেশি ভয়। প্রায় রোজই ডেঙ্গুজনিত জটিলতায় কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। নিজেরা সচেতন হওয়া সত্ত্বেও পারিপার্শ্বিকতার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ।
জ্বর এলে প্রথম থেকেই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকুন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিন। ডেঙ্গু জ্বর নিশ্চিত করার জন্য রক্তের নানা ধরনের পরীক্ষা রয়েছে। এগুলোর কোনোটি জ্বরের প্রথম দিকে, কোনোটি আবার পাঁচ দিন পেরোলে করতে হয়। জ্বরের কততম দিনে কোনো পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ এলে, আবার পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ রিপোর্ট না এলেও কোন কোন বিষয় দেখে ডেঙ্গু জ্বর হিসেবেই চিকিৎসা করাতে হবে, তা কেবল একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন। প্রথমবার ডেঙ্গু জ্বর হলে জটিলতার ঝুঁকি কম। তবে জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডেঙ্গু জ্বর বিষয়ে নানান পরামর্শ দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মতলেবুর রহমান।
জ্বর ছাড়াও অন্য উপসর্গ
ডেঙ্গু জ্বরে থাকে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ। দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। তবে এসবের বাইরে এখন সর্দি, কাশি, বমি, পাতলা পায়খানা কিংবা পেটব্যথার মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে।
তরল খাবার ভীষণ জরুরি
জ্বর হলেই প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। ওরস্যালাইন তো খেতেই হবে, অন্যান্য তরলের সঙ্গেও যোগ করে নিন খানিকটা লবণ। স্যুপ, তরল ডালের পাশাপাশি ফলের রসেও সামান্য লবণ যোগ করে নেওয়া যেতে পারে। ডাবের পানি প্রাকৃতিকভাবেই লবণসমৃদ্ধ। রোগী বাড়িতে পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ করতে না পারলে হাসপাতালে নেওয়াই ভালো। শিরাপথে স্যালাইনের প্রয়োজন হলে বাড়িতে নয়, হাসপাতালেই নিন।
বাড়িতে দৈনন্দিন জীবনযাপন
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন। কুসুম গরম পানিতে গা মুছিয়ে দিন। শরীরের যেসব স্থানে ঘাম হয়, সেসব স্থান ভালোভাবে মুছে দেওয়া উচিত। রোগী চাইলে কুসুম গরম পানিতে গোসলও করতে পারেন। রোজ পরিধেয় কাপড় বদলে দেওয়া ভালো।
মুখের পরিচ্ছন্নতা এ সময় গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের প্লাটিলেট খুব বেশি কমে গেলে রক্তপাতের আশঙ্কায় রোগীকে ব্রাশ করতে নিষেধ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতেও মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি করতে হয় এবং গজের টুকরা বা পরিষ্কার কাপড়ে পোভিডন আয়োডিন মাউথওয়াশ নিয়ে মুখের ভেতরটা পরিষ্কার করতে হবে, ঘুম ভাঙার পর এবং প্রতিবেলা খাওয়ার পর।
শোয়া বা বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর সময় তাড়াহুড়া করা যাবে না। ধীরেসুস্থে, প্রয়োজনে কারও সাহায্য নিয়ে উঠতে হবে। হঠাৎ মাথা ঘুরে রোগী পড়ে যেতে পারে, এ কারণে রোগী হাঁটাচলার সময় (যেমন বাথরুমে যাওয়ার সময়) কেউ কাছে থাকা ভালো।
জ্বর আসার দুই দিন আগে থেকে জ্বর সেরে যাওয়ার দুই দিন পর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে মশার মাধ্যমে জীবাণু ছড়াতে পারে। তাই এই মৌসুমে প্রত্যেকের বাড়িতেই মশারি ব্যবহার করতে হবে। আর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই জ্বর সেরে যাওয়ার দুই দিন পর পর্যন্ত মশারি ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে অন্তত দুই সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতেই হবে। মনে রাখবেন, জ্বর সেরে যাওয়ার পরের কয়েকটা দিনই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কে থাকেন কেউ কেউ। তবে ডেঙ্গুর মূল জটিলতা কিন্তু প্লাটিলেট কমে যাওয়া নয়। পানিশূন্যতা, রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো জটিলতাগুলো এড়ানো সম্ভব হলে রোগীর জীবন বেঁচে যায়। লবণযুক্ত তরলের সাহায্যে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখাটাই মূল বিষয়। তা ছাড়া এমন কোনো ওষুধ বা পথ্যও নেই, যা সেবন মাত্রই ডেঙ্গু সেরে যাবে কিংবা প্লাটিলেট বেড়ে যাবে। প্লাটিলেট কমে যাওয়া প্রতিরোধ করতে আগেভাগে রোগীর শরীরে প্লাটিলেট পরিসঞ্চালন করেও লাভ নেই।
বিপদচিহ্ন
পেটব্যথা কিংবা পেটে স্পর্শ লাগলে ব্যথা, পেট ফোলা, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত তিনবার বমি, প্রচণ্ড ক্লান্তি, অস্থিরতা, জ্ঞানের মাত্রা কমে যাওয়া (এলোমেলো কথা বলা, কাউকে চিনতে অসুবিধা হওয়া), একেবারেই খেতে না পারা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, শ্বাসকষ্ট কিংবা যেকোনো ধরনের রক্তপাত ডেঙ্গু জ্বরের বিপদচিহ্ন। এগুলোর যেকোনোটি দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
রক্ত পড়তে পারে নাক থেকে, মুখ থেকে, মাড়ি থেকে, সর্দি বা কাশির সঙ্গে, প্রস্রাব বা পায়খানার পথ দিয়ে। রক্তপাত হতে পারে ত্বকের নিচে, যা লালচে ফুসকুড়ির মতো দেখাবে। কারও কারও এমনিতেই ব্রাশ করলে মাড়ি থেকে রক্ত যায়। ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার পর এভাবে রক্ত গেলে চিকিৎসককে জানাতে ভুলবেন না।
মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিকের তারিখ ছাড়াই মাসিক হতে পারে ডেঙ্গুজনিত রক্তক্ষরণ হিসেবে, কিংবা জ্বরের সময় মাসিক হলে ডেঙ্গুর কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তপাত হতে পারে কিংবা রক্তের চাকা বা দলা পড়তে পারে। এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।
এসব বিপদচিহ্ন না থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসক যদি ভর্তির পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাহলে দেরি করবেন না। অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হলে বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কেউ না–ও বুঝতে পারেন। যেকোনো জটিল রোগীর জন্য একটি মিনিটও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ ক্ষেত্রে
বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। অনেকেরই দীর্ঘমেয়াদি রোগ থাকে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, কিডনি রোগ, লিভারের রোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর হলে একেবারেই অবহেলা করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ বন্ধ রাখতে হতে পারে। ডায়াবেটিসের সব ধরনের ওষুধ এ সময় নিরাপদ নয়। হৃদ্রোগের ওষুধের কারণে প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। তাই কোন ওষুধ চালানো যাবে, আর কোনটা যাবে না, তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেওয়াই নিরাপদ।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ কিংবা হার্ট ফেইলিওরে আক্রান্ত ব্যক্তি জ্বরের সময় কতটা পানি এবং লবণ গ্রহণ করতে পারবেন, তা বিশেষজ্ঞের থেকে অবশ্যই জেনে নিন। গর্ভবতী মা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশুর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। গর্ভবতী এবং স্তন্যদায়ী মায়ের অসুস্থতায় চিকিৎসা নিন।
প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যথানাশক সেবন করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনো স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন করবেন না।
শিশুদের জটিলতার হার বেশি
শিশুরা খুব সহজেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন বলেই জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার। শিশুর জ্বর হলে প্রথম দিনেই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি। শিশুবিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। বাড়িতে নানান ধরনের পানীয় ও তরল খাবার তৈরি করে দিন, অল্প অল্প করে বারবার দিন। ওদের পানীয়তেও খানিকটা লবণ যোগ করে দিন। ওরস্যালাইনও খাওয়ান। যেসব শিশু মায়ের দুধ খায়, তাদের মায়ের দুধ দিতে হবে বারবার। ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগে অন্য কোনো খাবার বা তরল দেওয়ার সুযোগ নেই। যেকোনো বয়সী শিশু যদি মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খেতে না পারে, তাহলে হাসপাতালে নিয়ে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তা ছাড়া শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়লে বা অতিরিক্ত ছটফট করলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে কিংবা অন্য কোনো বিপদচিহ্ন দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিন। পাতলা পায়খানা বা কোষ্টকাঠিন্য হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্রতিরোধ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। বাড়িতে ও বাড়ির আশপাশে কোথাও পানি জমে থাকতে দেবেন না। তা সেই পানি পরিষ্কারই হোক আর অপরিষ্কারই হোক।
দিন, রাত ও সন্ধ্যায় মশারি ব্যবহার করুন। বাসায় নেট লাগিয়ে নিতে পারেন।
শরীর যতটা সম্ভব, আবৃত রাখুন। ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরা ভালো।
মসকিউটো রিপেল্যান্ট ব্যবহার করুন। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে রিপেল্যান্ট ব্যবহারের আগে নিশ্চিত হয়ে নিন সেটি শিশুর উপযোগী কি না। তা ছাড়া কোনো রিপেল্যান্ট কারও হাতের তালু কিংবা মুখে লাগানো উচিত নয়।