২০০৪ সালে আমার বাবা পরলোকগমন করেন। ছোটবেলা থেকেই একটা কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর, ২০১৪ সালে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাইড আর্টে ভর্তি হই। ফাউন্ডেশন ক্লাসে শিক্ষকেরা বলতেন, ‘কিছু আঁকার আগে ভালো করে দেখো। হেডফোনের পরিবর্তে জানালা খুলে প্রকৃতির আওয়াজ শোনো। শুধু স্পর্শ নয়, অনুভব করতে চেষ্টা করো।’ বিষয়টার গভীরতা তখন বুঝতাম না। একদিন পরিপেক্ষিত ক্লাসে এক শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘স্যার, পুরোনো ভবনগুলো এত বিশাল আকৃতির বানানোর কারণ কী? এত বড় সিলিং, বারান্দা, কক্ষ—এগুলো কি অপচয় নয়?’ স্যার বলেছিলেন, ‘একটা জায়গা, আকৃতি, রং মানুষের মনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে।’
এটা বুঝতে আমার এক বছর সময় লেগেছিল; ২০১৫ সালে হিমাচল প্রদেশে ভ্রমণের সময়। প্রায় ৪২ ঘণ্টা ট্রেন-বাস ভ্রমণের পর এক ভোরে চোখের সামনে যখন হিমালয় দেখি, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম অনেকটা সময়। অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম আপনা-আপনি। জীবনে সেই প্রথম নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল।
তখন থেকেই একটা বিষয় নিজের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। পাহাড়ি বৃষ্টির মতো যখন-তখন আমি খুব সহজেই অভিমান করি, মানসিকভাবে আঘাত পাই। ধৈর্য ছিল, তবে মনের স্থিরতা ছিল না। নিজেকে শ্রেষ্ঠ করার প্রবণতা ছিল। সমস্যা হচ্ছে, আমি জানি না আমি মূলত কে? কী আমার উদ্দেশ্য?
যখন রাস্তায় একা একা হাঁটতাম, পাহাড় কিংবা সমুদ্রের কাছে গিয়ে বসতাম, এগুলো নিয়েই ভাবতাম। একদিন একটা তালিকা করলাম, ঠিক কোন কোন বিষয় আমাকে মানসিকভাবে বিচলিত করে। তালিকায় উঠে এল মন খারাপ করা বই, কবিতা, সিনেমা, গান, আলোকচিত্র এবং কিছু মানুষ। উদ্দেশ্য ছিল অন্তত একটা বছর এগুলো থেকে দূরে থাকব, যাতে কোনোভাবেই আমার মনে এসব প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এই এক বছরে আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস আর পরীক্ষা ছাড়া বাকি সময় নিজের মন গড়ার কাজে দিতাম। সফলতার গল্প খুঁজতে থাকি। কিছু ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, যাদের জীবনে স্বপ্ন আছে, যারা সব সময় সমস্যার সমাধান খুঁজে বেড়ায়। যন্ত্রসংগীত শুনি, মেডিটেশন শুরু করি আর কিছু বাক্য আমার ডিকশনারি থেকে বাদ দিই। এই যেমন আমি ভালো নেই, পারব না, সুন্দর না। শুরুটা ঠিক এভাবেই হয়েছিল।
যা–ই হোক, নিজেকে খুঁজে পেতে আমার চার বছর লেগে যায়। অভিধানের সুন্দর শব্দগুলোকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করি। শুধু বলার জন্য বলছি না। আমার আশপাশের মানুষদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, আমি গত পাঁচ বছরে কাউকে ভুলেও কোনো দিন বলিনি যে ‘আমি ভালো নেই। আজ আমার মন খারাপ।’
এখন আর মন খারাপ করা বই, কবিতা, সিনেমা বা কিছু মানুষের কারণে বিষণ্ন হই না। টাকা হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে, কিন্তু নিজে ভালো থাকা তো কোনো করপোরেট ডিল নয়, একান্তই ব্যক্তিগত। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ভালো থাকার রেসিপি কী? এক কথায় বলব, ‘ইচ্ছা।’
এখন আমি মনে করি, আমার মতো করে দুনিয়া কখনোই চলবে না। সবাই কথা শুনছে না বলে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। তবে কেউ যদি শোনে, নিঃসন্দেহে তাহলে ভালো লাগবে। আমি একসঙ্গে অনেক কাজ করি না। যেমন খাবার খেতে খেতে টেলিভিশন দেখলে আমি খাবারের স্বাদ পাই না। এমন অনেক কাজই আছে, যেগুলো একসঙ্গে করলে মানসিকভাবে স্থির হওয়া যায় না। প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে নিয়মিত শিখি। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা আমার জন্য তাঁদের জীবনের এক মিনিটও ব্যয় করেছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি মানুষের সান্নিধ্য যতটা উপভোগ করি, ঠিক ততটাই একাকিত্বকেও উদ্যাপন করি। সুযোগ পেলেই কাঁচা মাটিতে কিংবা ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটি, গাছপালা ছুঁয়ে দেখি। ঘুম থেকে উঠে দিনের শুরুতে কিছুক্ষণ বুকভরে শ্বাস নিই, পানি খাই। আনন্দ নিয়ে কাজ করি, আবার মাঝেমধ্যে কিছুই না করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। শব্দের অনেক শক্তি, তাই বিষাক্ত শব্দ ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আর এভাবেই এখন আমি অনেক ভালো আছি।