জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে একটি শিশুর শারীরিক ও স্নায়বিক বৃদ্ধি হতে থাকে। কিন্তু যদি দেখা যায়, শিশুর মাথার আকার বয়সের তুলনায় বাড়ছে না, শিশুর যে সময়ে ঘাড় শক্ত হওয়ার কথা, বসা বা হামাগুড়ি দেওয়ার কথা, সেই সময়ে সেটা করছে না, মায়ের চোখে চোখ রেখে হাসছে না, ডাকলে ফিরে তাকাচ্ছে না, হাত সব সময় মুষ্টিবদ্ধ করে রাখছে, হাত অস্বাভাবিক শক্ত বা নরম, অস্বাভাবিক নড়াচড়া বা কাঁপুনি দিচ্ছে, তাহলে ধারণা করা যায়, শিশুর মস্তিষ্কের স্থিতিশীল কোনো সমস্যা হচ্ছে, যা তার চলনশক্তি ও দেহের সঠিক ভঙ্গিতে থাকায় সমস্যা সৃষ্টি করছে। এ সমস্যাকেই চিকিৎসার ভাষায় বলে সেরিব্রাল পালসি। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে প্রায় ৩ দশমিক ৪ জন সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত।
সেরিব্রাল পালসি কেন হয়
এ জন্য দায়ী অনেক কারণ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গর্ভকালীন, জন্মের সময় ও জন্মের পরের বিভিন্ন জটিলতা।
জন্মের পরপরই নবজাতকের কান্নাকাটি না করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে পরবর্তী সময়ে সেরিব্রাল পালসি হতে পারে।
জন্মগত ইনফেকশন, যেমন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস ভাইরাস, সিফিলিস, টক্সোপ্লাজমাসহ বিভিন্ন ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত হলে নবজাতক মস্তিষ্কের বিভিন্ন গঠনগত সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে।
অপরিণত অবস্থায় ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুরও সেরিব্রাল পালসি হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের পরে অপরিণত মস্তিষ্কে স্ট্রোক হলেও শিশুর এই রোগ হতে পারে।
অপরিণত মস্তিষ্কে আঘাত বা ইনফেকশন থেকে এমন সমস্যা হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিস যদি অতিরিক্ত হয় এবং তা যদি মস্তিষ্কে জমা হয়ে কারনিক্টেরাস নামের রোগে আক্রান্ত করে, তাহলে এ রোগ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অসুস্থতা, ক্ষতিকর ওষুধ সেবন ও ধূমপানের অভ্যাস থেকেও শিশুর এমন রোগ হতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের জিনগত কারণেও এই সমস্যা হতে পারে।
সেরিব্রাল পালসি কোনো একক রোগ নয়। এ রোগে আক্রান্ত শিশুর দৃষ্টিশক্তি, কথা বলা ও শেখার সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, মৃগীরোগ, পেশি নড়াচড়ার সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধা দেখা যায়। এ ছাড়া এদের গিলে খেতে, ঘুমাতে, প্রস্রাব-পায়খানার নানা সমস্যা হয়। বারবার ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শরীরের কোন অংশ কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে কয়েকভাবে সেরিব্রাল পালসি ভাগ করা যায়—
স্প্যাসটিক সেরিব্রাল পালসি
ডিস্কাইনেটিক সেরিব্রাল পালসি
অ্যাটাক্সিক সেরিব্রাল পালসি
মিশ্র সেরিব্রাল পালসি
সেরিব্রাল পালসি নির্ণয়ের জন্য রোগীর ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা দরকার হয়। রোগের কারণ জানতে এবং অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না, তা বুঝতে বেশ কিছু পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়।
পরীক্ষাগুলো হলো—
মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান/এমআরআই
ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইইজি)
বিভিন্ন রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা
এ ছাড়া শিশুর বুদ্ধি পরীক্ষা, চোখ ও কান পরীক্ষা করা লাগতে পারে। সঙ্গে অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলোর কারণও অনুসন্ধান করতে হবে।
সেরিব্রাল পালসির নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে এ অবস্থায় আক্রান্ত শিশুদের জীবন উন্নত করার জন্য কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। আর সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারলে এদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা সম্মিলিত উদ্যোগে করতে হয়। যে দলে মা–বাবা বা অভিভাবক থেকে শুরু করে শিশু নিউরোলজিস্ট, অফথ্যালমোলজিস্ট, অর্থোপেডিশিয়ান, ডেনটিস্টসহ আরও অনেক চিকিৎসক যেমন থাকেন, তেমনই থাকেন ডেভেলপমেন্টাল, অকুপেশনাল স্পিচ থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, পুষ্টিবিদ ও সমাজকর্মী।
সবার আগে জেনে রাখুন, এটা কোনো মানসিক সমস্যা নয়। খিঁচুনি, মাংশপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, মাংশপেশির অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া, ঘুমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ইনফেকশন, আচরণগত সমস্যা—এসবের চিকিৎসা ওষুধের মাধ্যমে করা হয়। বসা, হাঁটা, দৈনন্দিন কাজ, যেমন ব্রাশ করা, জামাকাপড় পরা, কথা শেখা—এগুলোর জন্য থেরাপি দেওয়া হয়। মাংশপেশি অতিরিক্ত শক্ত হয়ে হাড়ের আকার পরিবর্তন হলে অস্ত্রোপচার করাও লাগতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক কিংবা ম্যানুয়াল সাহায্যাকারী ডিভাইস দিয়েও শিশুর চলাফেরা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায়। বর্তমানে স্টেম সেল থেরাপি দিয়েও চিকিৎসা করা হচ্ছে।
সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতাল মিলে ৩৪টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে এ ধরনের শিশুদের শনাক্ত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের নিয়মিত চেকআপ ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর সঠিক যত্ন নিতে হবে। শিশুর মস্তিষ্কের ইনফেশন প্রতিরোধে মায়ের রুবেলাসহ সন্তানের সব টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
ডা. ফারাহ দোলা, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর