যাঁদের প্রাক্-ডায়াবেটিস বা প্রিডায়াবেটিস আছে, তাঁদের শতকরা ৫০ জন ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন, যদি যাপিত জীবনে পরিবর্তন না আনেন। প্রাক্-ডায়াবেটিস আসলে কী? রক্তে চিনির মাত্রা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেড়ে যায়, কিন্তু ডায়াবেটিস নির্ণয়ের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম থাকে, সে অবস্থাকে বলে প্রিডায়াবেটিস বা প্রাক্-ডায়াবেটিস। অনেকে বলেন বর্ডার লাইন ডায়াবেটিস। এটি ডায়াবেটিস নয়, কিন্তু ডায়াবেটিসের ঘণ্টাধ্বনি। কিন্তু সময়মতো এর বিরূদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এটি অচিরেই পূর্ণ ডায়াবেটিসে রূপ নেবে। সত্যি বলতে কি, প্রাক্–ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়া একটি সৌভাগ্য। কারণ, এর ফলে আপনি আপনার সম্ভাব্য ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন, জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন এবং কমিয়ে ফেলতে পারেন ভবিষ্যত ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
ডায়াবেটিসের মতো প্রাক্–ডায়াবেটিস শনাক্ত করতেও ওজিটিটি বা ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করতে হয়। অভুক্ত অবস্থায় সকালে যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৬.১-৬.৯ মিলিমোল/লিটার এবং ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর যদি ৭.৮-১১ মিলিমোল/লিটার হয়, তবে তাকে বলা হবে প্রাক্-ডায়াবেটিস। তিন মাস সময়কালব্যাপী গ্লুকোজের গড় মাত্রা নির্ণয়ের একটা মাপকাঠি হাল জামানায় ব্যবহার করা হয়। এটি হলো এইচবি এ-১ সি। এর মাত্রা ৬-৬.৪ শতাংশ হলেও বলা যাবে প্রাক্-ডায়াবেটিস।
এটি একদিকে যেমন ডায়াবেটিসের ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে শুরু করে, পাশাপাশি হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি ও কিডনির ক্ষতি করার অশনিসংকেত প্রদান করে। প্রাক্-ডায়াবেটিস অবস্থায় রক্তে যে চিনিরমাত্রা থাকে, তা আপনার হৃদ্রোগ এবং কিডনির রোগ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। বরং বলা যায়, বড় বড় রক্তনালির অসুখ এ অবস্থায় বেশি দানা বাঁধে, যেমন স্ট্রোক, করোনারি–সংক্রান্ত হৃদ্রোগ ইত্যাদি। তাই অনেকে ভাবেন, আমার ডায়াবেটিস বর্ডার লাইনে, তাই সমস্যা হবে না। আসলে ধারণা ভুল।
বয়স ৪৫–এর বেশি হলে প্রাক্-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পুরুষের কোমরের মাপ ৪০ ইঞ্চি আর মহিলাদের ৩৫ ইঞ্চির বেশি হওয়া মানেই কিন্তু ঝুঁকি বেড়ে গেল। খাদ্য তালিকায় যদি থাকে লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমল পানীয়, মিষ্টি, ক্যান্ডি, বার্গারের আধিক্য এবং শাকসবজি, ফলমূল ও তন্তুজাতীয় খাবার কম খান, তবে বিপদ অপেক্ষমান। রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, এলডিএল) যদি বেশি থাকে, আর উপকারি কোলেস্টেরল (এইচডিএল) যদি কমে যায়, তবেই বিপদ। এছাড়া শরীরচর্চা বিমুখতা বৃদ্ধি করে ঝুঁকি। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মা এবং যাঁরা নয় পাউন্ডের বেশি ওজনের সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাঁরাও ঝুঁকিগ্রস্ত। পলিসিস্টিক ওভারি যাঁদের রয়েছে, তাঁদের অন্যান্য আপদের পাশাপাশি ধেয়ে আসতে পারে বহুমূত্র। ঘুমে নাক ডাকার অভ্যাসও কিন্তু বৃদ্ধি করে প্রাক্-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
আশার কথা হলো প্রাক্-ডায়াবেটিস পর্যায়ে প্রতিরোধ জোরদার করলে ডায়াবেটিস থেকে এমনকি আজীবনের জন্য নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। সে জন্য করণীয় হলো ওজনকে বাগে রাখতে হবে। শতকরা পাঁচ থেকে সাত ভাগ শরীরের ওজন কমানোর পাশাপাশি প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে জোর কদমে হাঁটলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যাবে শতকরা ষাট ভাগ। সুতরাং মনোযোগী হতে হবে মেদভুঁড়ি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার দিকে। পেটের মেদ সবচেয়ে ক্ষতিকর। এটাকে বলা হয় ভিসেরাল ফ্যাট। ইনসুলিনের কার্যকারিতা ভোঁতা করে দেয়ার জন্য ভিসেরাল ফ্যাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাবারের মেনু পাল্টে ফেলুন। হরেক রকম সবজি, সালাদ আর ফলমূলে পূর্ণ হোক খাবারের থালা। সরল শর্করাজাতীয় খাবার কমিয়ে দিন, তার জায়গায় স্থান দিন ফাইবারসমৃদ্ধ জটিল শর্করা। সঙ্গে থাকুক আমিষ, অল্পস্বল্প অসম্পৃক্ত চর্বি। ধূমপানকে বিদায় বলুন। কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমিয়ে ফুরফুরে হয়ে উঠুন। নিদ্রা হোক সুখময়।
প্রাক্–ডায়াবেটিসকে অবহেলা করবেন না। যাঁদের প্রাক্–ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের জন্য নিজেকে বদলে ফেলার এটাই আদর্শ সময়। বয়স ৪০ পেরোলে তাই রক্ত পরীক্ষা করে দেখুন, আপনার প্রাক্–ডায়াবেটিস আছে কিনা, আর সেই মতো ব্যবস্থা নিন।
লে. কর্নেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সিএমএইচ, ঢাকা