নতুন মা রুকসানা প্রীতি। সন্তানের বয়স ১০ মাস। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা তাঁকে জেঁকে বসেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চাকরিতে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা। এখন কিছুটা সামলে উঠেছেন। সন্তানকে আরেকটু সময় দিয়ে শিগগিরই কাজে ফিরবেন বলেও মনস্থির করেছেন।
প্রীতি তাঁর প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা নিয়ে বলেন, ‘ডেলিভারির ১০-১৫ দিন পর থেকেই আমার সমস্যা শুরু হয়। তখন বুঝতে পারতাম না এমন কেন হচ্ছে। আপু, ভাবি যাঁকেই বলি, তাঁরা সবাই জানান যে এটা স্বাভাবিক, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবু বড় হতে থাকে আর আমার সমস্যাও বাড়তে থাকে। খুব ছোট ছোট ব্যাপারে প্রচণ্ড রাগ হতো। আর এত বেশি রাগ হতো যে নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। সব ভাঙচুর করতে ইচ্ছা করত। মরে যেতেও ইচ্ছা করত। মনে হতো, আমি হতাশার অতল গহ্বরে পড়ে যাচ্ছি।’
প্রীতি জানান, তাঁর অনেক রাগ, অভিমান হতো। কমবেশি সবার ওপর। দু-একবার বাচ্চাকে বকাও দিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে আবার নিজেরই খারাপ লাগত। কান্নাকাটি করতেন। তাঁর ভেতরে কী হচ্ছে, কাউকে বোঝাতেই পারতেন না। বাচ্চার বাবার কাছ থেকেও সে রকম মানসিক সমর্থন পাননি। এরপর নিজেই গুগল করে, পড়াশোনা করে বুঝলেন যে তাঁর পেশাদার সাহায্য প্রয়োজন। তারপর কী হলো? প্রীতি বললেন, ‘আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই। উনি কিছু মেডিসিন দেন। সেগুলোতে কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার আগের মতো সমস্যা শুরু হলো। এরপর আমি ডাক্তার বদলাই। উনি আমাকে ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং নিতে বলেন। এখন আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু এখনো মনে হয় সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’
প্রায় সব মা-ই প্রসবের পর প্রাথমিক বিষণ্নতা বা বেবি ব্লুর মধ্য দিয়ে যান। এই প্রাথমিক বিষণ্নতা কারও কারও ক্রনিক ডিপ্রেশন বা দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতায় পর্যন্ত গড়ায়। দেশের প্রায় ৩৯ শতাংশ নতুন মা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যান। সাধারণত প্রসবের ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নারীরা এই বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, যা স্থায়ী হতে পারে দুই বছর পর্যন্ত। কারও কারও ক্ষেত্রে এই বিষণ্নতা থেকে বের হতে আরও বেশি সময় লাগে।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা
বেবি ব্লুর মতো এটা কোনো সাময়িক বিষণ্নতা নয়। পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনের পর সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সন্তানের মায়ের দিক থেকে সবার মনোযোগ সরে যায়। এদিকে একজন নতুন মায়ের হরমোনের পরিবর্তন (প্রসবের পর ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা দ্রুত হ্রাস), পূর্ববর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস, মানসিক চাপপূর্ণ জীবন (আর্থিক সমস্যা, সম্পর্কের সমস্যা, ঘুম ও বিশ্রামের ঘাটতি) এসবের মধ্য দিয়ে যান। এগুলো সাধারণত নজরে আসে না। ফলে নতুন মা মন খারাপ, হতাশা, অতিরিক্ত উদ্বেগ ও অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করেন। কাজকর্মের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। কেউ কেউ খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেন। ফলে ওজন কমে যায়, কারও আবার বেড়ে যায়। অনেকেই অকারণে অপরাধবোধে ভোগেন, নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। একাকিত্ব, অসহায়ত্ব তাঁদের চেপে ধরে। জীবন সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন।
নতুন বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
সন্তান প্রসবের পর বাচ্চার পাশাপাশি সবাই মিলিয়ে নতুন মায়েরও খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারের সবাই তাঁকে মানসিকভাবে সমর্থন জোগান।
নতুন বাবা ও জীবনসঙ্গীর দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সঙ্গী, নতুন মায়েরকে ভরসা দিন, পাশে থাকুন। নতুন মায়ের ভুল ধরবেন না। তেমন কিছু হলে তাঁকে বুঝিয়ে বলুন। এই সময়ে তাঁকে একটু বেশিই সময় দিন।
সঙ্গীর ছোট ছোট ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন তাঁর কথা। তাঁর যত্ন করুন, শিশুর যত্নে তাঁকে সাহায্য করুন।
মাঝেমধ্যে আপনার জীবনসঙ্গী নতুন মাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান, বই পড়ায় উৎসাহ দিন। কঠিন পরিশ্রম হয়, এমন কাজের দায়িত্ব থেকে তাঁকে বিরত রাখুন।
নতুন মায়ের পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করুন।
নতুন মায়েদের করণীয়
কমবেশি সব মা-ই এই সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়ে থাকেন। তাই আপনি নতুন মা হয়ে এসবের সম্মুখীন হলে ভয় পাবেন না, চারপাশের পরিবেশ প্রতিকূল হলেও নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবেন। নিজের আবেগ-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন না।
বিষণ্নতাবোধে মন খুলে কথা বলুন, আপনার সমস্যা শেয়ার করুন, সাহায্য চান।
শিশুর যত্নের পাশাপাশি নিজের যত্ন নিন। নিজের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক পুষ্টি এবং নিয়মিত ব্যায়াম নিশ্চিত করুন।
একই ধরনের ফেসবুকের গ্রুপে (যেখানে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন অন্য মায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে পারেন) যোগ দিন। জানতে পারবেন, আপনি একা নন। আর এটাই আপনাকে শক্তি জোগাবে! সেখান থেকে সবার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া, সমস্যার সমাধান ও উত্সাহ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রামে অংশ নিন। এগুলো প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা কাটাতে সাহায্য করবে।
বিষণ্নতার স্থায়িত্ব বেশি হলে বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সহায়তা নিন। থেরাপি, ওষুধের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। আর সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মায়েরা প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতার মতো মানসিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠেন।
বিষণ্নতা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। বিষণ্ন মা নিজের যেমন যত্ন নিতে পারেন না, তেমনি সন্তানের যত্নও নিতে পারেন না। পাশাপাশি এমন কাজ করে বসেন, যাতে সন্তানের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে, সন্তানের ওপর যা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক-মানসিক প্রভাব ফেলে। তাই প্রসব-পরবর্তী এই বিষণ্নতাকে প্রতিকারের আগে প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারের সবাই, বিশেষ করে সঙ্গীকে নতুন মায়ের পাশে থাকতে হবে। যাতে নতুন মায়েদের নতুন যাত্রায় দুশ্চিন্তা কম হয়, আত্মবিশ্বাস আর আনন্দ থাকে বেশি।