হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখার সহজ ছয় উপায়

হার্টই যদি ঠিক না থাকে, ভালোবাসবেন কী করে! নিজের হার্টকে ভালোবাসছেন তো? ছবি: প্রথম আলো
হার্টই যদি ঠিক না থাকে, ভালোবাসবেন কী করে! নিজের হার্টকে ভালোবাসছেন তো? ছবি: প্রথম আলো

বুকের ভেতর যে মসৃণ পেশি পৌনঃপুনিক ছান্দিক সংকোচনের মাধ্যমে আপনার সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে চলেছে, সেটাই হৃৎপিণ্ড। শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ অঙ্গের যত্ন না নিলেই সর্বনাশ। একটু সচেতন থাকলেই কিন্তু হৃৎপিণ্ড সুস্থ-সবল রাখা যায়। এ জন্য আছে বেশ সহজ কিছু উপায়।

পরিমিত খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ না নেওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণ আর ধূমপান না করা—দৈনন্দিন জীবনে এ কয়টি অভ্যাস আপনার হৃৎপিণ্ডকে রাখবে সুস্থ-সবল। দেখে মনে হতে পারে, আরে এসব মেনে চলা তো বাঁ হাতের খেল! আসলে কিন্তু তা নয়, মানে ব্যাপারটা এত সহজ নয়।
রোজকার জীবনে নতুন কোনো কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যেখানে কঠিন ব্যাপার, সেখানে একসঙ্গে এতগুলো অভ্যাসের পরিবর্তন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে সমস্যা হলে সমাধান থাকবেই। দৈনন্দিন জীবনে নানা কৌশলে আপনি এসব অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন খুব সহজেই। আসুন জেনে নিই এভাবে হৃৎপিণ্ড ভালো রাখার সহজ ছয়টি উপায়:

খেলার ছলে ব্যায়াম
হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে সপ্তাহে ন্যূনতম পাঁচ দিন করে রোজ ৩০ মিনিট ব্যায়ামের প্রয়োজন বড়দের। কিন্তু ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকলে হুট করে শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ঘাম ঝরানো ভীষণ ক্লান্তিকর ব্যাপার। এ কারণে বাসায় বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তাঁদের সঙ্গে খেলার মধ্য দিয়ে ব্যায়ামের কাজটা সেরে নিতে পারেন। সেটা হতে পারে কায়িক পরিশ্রমের যেকোনো খেলা।
বাচ্চাকাচ্চা না থাকলেও সমস্যা নেই। একটু হাঁটা কিংবা সাংসারিক কাজের মধ্য দিয়ে ব্যায়ামের রুটিন সেরে নিতে পারেন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম মানে যে টানা আধঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে, সেটা কিন্তু নয়। এ সময়টাকে ভেঙে নিতে পারেন। সকালে ১০ মিনিট ঘাম ঝরালেন, দুপুরে অফিসে মধ্যাহ্নবিরতির সময় ১০ মিনিট হেঁটে খেতে গেলেন, অফিস থেকে ফেরার পর বিকেলে কিংবা রাতে এ রকম আরও কিছু কাজ দিয়ে ব্যায়াম সেরে নিতে পারেন।

খাদ্যাভ্যাস পাল্টানো
আপনি প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত ‘স্যাচুরেটেড ফ্যাট’ (ক্ষতিসাধক স্নেহ পদার্থ) খেতে ভালোবাসেন। যেমন ধরুন, ‘রেড মিট’ কিংবা পূর্ণমাত্রায় ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি। হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে এসব খাবার ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কীভাবে? আপনি তো বদভ্যাসের দাস! ভাববেন না, উপায় আছে। অভ্যাসটা ধীরে ধীরে পাল্টান। ‘রেড মিড’-এর মেন্যুতে ধীরে ধীরে ‘লো-ফ্যাট মিট’ যোগ করুন। দুগ্ধজাত খাবারের পরিবর্তে জলপাই কিংবা ‘ক্যানোলা অয়েল’ খেতে পারেন। খাবারে লবণের পরিমাণ কমান। প্রক্রিয়াজাত কিংবা প্যাকেটজাত খাবার কম খান। প্রতিদিনের খাবারে ১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খাবেন না।
ভালো করে রান্না করলে শাকসবজি খেতে কিন্তু দারুণ লাগে। শাকসবজি খান প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কাপ, সঙ্গে থাকুক ফলমূল। শস্যদানা বা ‘গ্রেইন’যুক্ত খাবার খেতে পারেন, যেমন বাদামি চাল, বার্লি, পপকর্ন, ওটমিল, গমের রুটি, গমের প্যানকেক ইত্যাদি।

ফাস্ট ফুডের নেশা থেকে বেরিয়ে আসুন। খেলেও বেছে বেছে খান। ছবি: প্রথম আলো

বিশ্রাম নিন
দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে পরিমিত বিশ্রাম নিন। মানে, স্রেফ কিছুই করবেন না, কোনো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। পূর্ণমাত্রায় বিশ্রাম হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী। যুক্তরাষ্ট্রের ‘একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়াবেটিস’-এর চিকিৎসক সুসান মুরের ভাষ্য, হৃৎপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় মানসিক চাপ ‘খলনায়ক’-এর ভূমিকা পালন করে। গোটা স্বাস্থ্যের ওপরই এটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
আর তাই মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ান। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করুন। সাংসারিক কিংবা অফিসের কাজ ভুলে যান। স্রেফ নিজের জন্য বিশ্রাম নিন। সেটা শুয়ে-বসে যেকোনোভাবে। বিশ্রাম নেওয়ার পর দেখবেন ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। মানে, ওই বিশ্রামের সময়টুকু আপনাকে কাজের জন্য উজ্জীবিত করে তুলবে।

ওজনকে বশ মানান
স্থূলকায় মানুষের ওজন নিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই। ওজন কমাতে ক্যালরির হিসাব করছেন, ব্যায়াম করছেন কিন্তু তারপরও কমছে না কিছুতেই। একটু মাথা খাটান। আপনি কি স্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন? স্বাস্থ্যকর খাবার আর ক্যালরিযুক্ত খাবার কিন্তু এক নয়। পুষ্টিকর খাবার খান এবং ক্যালরি খরচ ও গ্রহণে ভারসাম্য আনুন। তরল খাবার খেতে পারেন। শাকসবজি থাকুক প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। এ ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম করুন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বাধ্যতামূলক করুন। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা না নিয়ে হেঁটে কিছুটা পথ এগোন। বাসায় ফেরার পথেও একই কৌশল অনুসরণ করুন।

ধূমপান ছাড়ার চ্যালেঞ্জ জিতুন
ধূমপানের অপকারিতা সমন্ধে আমরা সবাই জানি। এ বদভ্যাসটি ছাড়ার নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। যে যার মতো করে চেষ্টা করে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ, পরিবারের সাহায্য কিংবা এ দুটি ব্যাপার মিলিয়ে চেষ্টা করলে সুফল পেতে পারেন। ধূমপানের অপকারী দিকগুলো নিয়ে ভাবুন। এটা ছাড়ার উপকারী দিকগুলোতে মনোযোগী হতে পারেন। ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করাই শ্রেয়। মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। এটা ধূমপানে আপনাকে আরও আকৃষ্ট করবে। শরীরচর্চার মধ্যে থাকলে ধূমপানের ইচ্ছা কমে যেতে পারে। কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে থাকলেও সুফল পেতে পারেন।

ইতিবাচক মনোভাব ও চাপ কমান
হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে মানসিক প্রশান্তির বিকল্প নেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্র, সমাজ কিংবা পরিবার থেকে মানুষ নানাভাবে চাপে থাকে। এসব চাপ যেমন মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি বুদ্ধি করে কমাতেও হবে। প্রতিদিনের কাজের চাপ শেষে নিজের জন্য আলাদা করে একটু সময় বের করুন। পছন্দের গান শুনতে পারেন কিংবা বই পড়তে পারেন। কোনো কারণে মনে কষ্ট পেলে তা বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নিন। মনে কষ্ট পুষে রাখবেন না। এ ধরনের অভ্যাস হৃদ্‌রোগ ডেকে আনে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে চমৎকার সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলা।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ একাকিত্ব বোধ করেন এখনকার মানুষ। অর্থাৎ ১৯৮০ সালে এ হার ছিল ২০ শতাংশ, এখন ৪০ শতাংশ। একাকিত্ব শুধু মানসিক ক্ষতি করে না, শারীরিক ক্ষতিও করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, কেউ যখন কারও সঙ্গে কথা বলে, তখন হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। এতে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম দারুণ সচল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে মানসিক চাপ কমানো এবং চারপাশের মানুষের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলাও জরুরি।