বাংলাদেশে দিন দিন হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বংশগত কারণ ছাড়াও অনিয়মিত জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ভুল ডায়েট, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নানা কারণে হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বংশগত কারণকে কোনো পরিবর্তন করা না গেলেও উল্লিখিত প্রতিটি কারণকে পরিবর্তন বা সংশোধন করে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমানো সম্ভব। শুধু তা–ই নয়, এই পরিবর্তনগুলো হৃদরোগের চিকিৎসা করা ছাড়াও প্রতিরোধ করতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
খাদ্যাভ্যাসের যে পরিবর্তনগুলো হৃদরোগের উপসর্গ কমিয়ে হৃদরোগ চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, সেগুলো হলো:
ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, কুড়কুড়ে বা মচমচে কেনা খাবার, বেকারি ফুড ইত্যাদিতে অনেক ট্রান্সফ্যাট থাকে। এই প্রকার চর্বি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আর্টিফিশিয়াল খাবারে ট্রান্সফ্যাট অনেক বেশি থাকে। যেমন আর্টিফিশিয়াল চিজ, মার্জারিন, ফ্রোজেন ফাস্ট ফুড ইত্যাদি। এ ছাড়া বেকারি ফুড, যেমন বিস্কুট, কেক, পাই ছাড়াও ফাস্ট ফুড, চিপস, ফ্রোজেন পিৎজা বা অন্য ফাস্ট ফুড ইত্যাদিতে অনেক বেশি ট্রান্সফ্যাট থাকে। তাই যাদের হৃদরোগ রয়েছে, তাদের তো বটেই, হৃদরোগ প্রতিরোধেও এই ক্ষতিকর ফ্যাট এড়িয়ে চলতে হবে। যেকোনো খাবার কেনার আগে অবশ্যই দেখে নিন তাতে কোনো ট্রান্সফ্যাট আছে কি না। ট্রান্সফ্যাটমুক্ত খাবার হৃদরোগ চিকিৎসা ও প্রতিরোধে অবশ্যই জরুরি।
সম্পৃক্ত চর্বি, যেমন ঘি, বাটার, ডালডা, গরুর চর্বি, আইসক্রিম, মালাই, ঘন দুধ ইত্যাদি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তবে রান্নায় ভালো উদ্ভিজ্জ তেল, যেমন অলিভ অয়েল, সান ফ্লাওয়ার তেল, ক্যানোলা ওয়েল, রাইস ব্রান তেল ইত্যাদি পরিমিত পরিমাণে খেলে ভালো।
সোডিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস হলো খাবার লবণ। সোডিয়াম লবণ ছাড়াও অনেক খাবারে ও খাদ্য উপাদানে থাকে। যে খাবারগুলোতে বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা, টেস্টিং সল্ট, সয়া সস, সস, বাটার, ফিশ বস ইত্যাদি উপাদান থাকে সেগুলোতে অনেক সোডিয়াম থাকে। আবার প্রাকৃতিক খাবার, যেমন গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, প্রসেস ফুড, খাসির মাংস ইত্যাদি খাবারে অনেক সোডিয়াম থাকে। বেশির ভাগ হৃদরোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে তাই সোডিয়াম নিয়ন্ত্রিত ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়৷
অনেকে খাবারের সঙ্গে আলাদা লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকলেও অতিরিক্ত সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার না জেনে খেয়ে ফেলেন, যা তাঁদের হৃদরোগের ঝুঁকি ও সমস্যা বাড়ায়। তাই খাবারের সঙ্গে আলাদা লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি প্যাকেটজাত খাবার, আচার, অর্গান মিট, বেকারি কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট, রেস্টুরেন্টের খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সরল শর্করা ও সরল শর্করাযুক্ত খাবার, যেমন চিনি, চকলেট, গুড়, কোল্ড ড্রিংকস, মিষ্টি, এনার্জি ড্রিংকস, কমার্শিয়াল ফ্রুট জুস ইত্যাদি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হয়। এ ধরনের খাবার থেকে রক্তে দ্রুত গ্লকোজ তৈরি হয়। অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডস (TG)–এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা হৃদরোগের জন্য দায়ী।
তবে কমপ্লেক্স কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাবার, যেমন লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, ওটস, চিড়া, মিষ্টি আলু, কচুসহ অনেক সবজি কমপ্লেক্স কার্বহাইড্রেটের ভালো উৎস। এ ধরনের কার্বোহাইড্রেট থেকে প্রাপ্ত ফাইবার বা খাদ্য আঁশ রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে ও ভালো কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এই ধরনের কার্বোহাইড্রেটের ক্যালরি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
হৃদরোগীর জন্য প্রোটিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা পুষ্টি উপাদান। যেসব হৃদরোগীর কিডনি ভালো থাকে তাঁদের জন্য শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য কমপক্ষে ১.২ থেকে ১.৫ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হয়। মাছ হৃদরোগীদের প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। মাছ থেকে প্রোটিন ছাড়াও ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা হার্টের জন্য উপকারী। এ ছাড়া মুরগির মাংস, ডাল, ডিম, লো ফ্যাট দুধ, দই, বাদাম প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। তবে কিডনির সমস্যা থাকলে ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শমতো প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত৷
ছোটবেলা থেকে যারা ফল ও শাকসবজি খায় তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। তবে হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতেই শুধু নয়, হৃদরোগের প্রতিকারের জন্য শাকসবজি ও ফলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলের ও সবজির পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে আবার ফল ও সবজির ফাইবার খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে, ওজন ও প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সবজির মিনারেল ও ভিটামিন, বিশেষ করে ভিটামিন সি, ই ও এ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে যা, একজন হৃদরোগীর অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমায়।
রোজ ২ থেকে তিন পরিবেশনে সবজি খেলে ভালো। ব্যক্তি বিশেষ ২ থেকে ৩ পরিবেশনে ফল খাওয়া ভালো। সালাদ, মিক্স সবজি নিরামিষ, শাক, ফল ও ফলের সালাদ অনেক উপকারী। তবে চিনি যুক্ত ফলের রস অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই ওজন কমাতে হয়। ওজন কমাতে পরিমিত পানি গ্রহণ আবশ্যক। অবশ্য কিছু কিছু হৃদরোগে পানি ও তরল নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। ডাবের পানি, লো ফ্যাট দুধ, টক দই এর লাচ্ছি, সবজির স্যুপ, চিকেন সুপ, গ্রিন টি, লেবু পানি, দারুচিনি চা, চিনি ছাড়া ঘরে বানানো ফলের জুস ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর পানীয়।
খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি অন্যান্য যে বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• খাবারের জন্য নির্ধারিত সময় মেনে চলা
• ঘরে বানানো খাবার খাওয়া
• ধূমপান বা যেকোনো নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকা
• রোজ ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা
• দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা
• হাসিখুশি থাকা
• নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম বা হাঁটা
• নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
• এক্সপার্ট ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে রোগ বিষয়ে কথা না বলা
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ, এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা