সম্পর্ক উন্নয়নে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা

উচ্চমাত্রার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে চলতে পারে ও চাপমূলক পরিস্থিতি সহজেই মোকাবিলা করতে পারে। এ ছাড়া আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক যোগাযোগপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

প্রতীকী ছবি

প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব, চাহিদা ও অনুভূতি প্রকাশের ধরন ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা রকমের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হয়ে থাকে। শুধু উচ্চমাত্রার বুদ্ধিসম্পন্ন হলেই ব্যক্তি সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তা নয়, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন উচ্চমাত্রার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার। উচ্চমাত্রার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে চলতে পারে ও চাপমূলক পরিস্থিতি সহজেই মোকাবিলা করতে পারে। এ ছাড়া আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক যোগাযোগপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

প্রতীকী ছবি

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হলো ব্যক্তির নিজের অনুভূতিকে শনাক্ত করতে পারা ও আবেগীয় প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা; পাশাপাশি অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারা, সহমর্মিতা প্রকাশ করা এবং অন্যের আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা। মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গোল্ডম্যানের মতে, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন:

১. আত্মসচেতনতা (Self-Awareness): ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বুঝতে পারার মাধ্যমে নিজেকে জানা ও সেগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া করতে পারার ক্ষমতা হলো আত্মসচেতনতা। আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবার, কর্মস্থল ও সামাজিক জীবনে খাপ খাওয়ানো সহজ হয়।

প্রতীকী ছবি

২. আত্মনিয়ন্ত্রণ (Self-Regulation): অতিমাত্রার আবেগীয় প্রতিক্রিয়া (যেমন রাগ, জেদ, হিংসা, ঈর্ষার ফলে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া, ক্ষতিকর কিছু করে ফেলা ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। আত্মনিয়ন্ত্রণের ফলে ব্যক্তি যৌক্তিকভাবে চিন্তা ও পরিকল্পনা করে কোনো কাজ করতে পারে এবং সফলতা অর্জন করতে পারে।

৩. প্রেরণা (Motivation): প্রেরণা হলো ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা, যা কোনো কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করে। উদ্দীপনা ছাড়া ব্যক্তিজীবন অনেকটাই অস্তিত্বহীন। কর্মোদ্যমী হওয়া, চ্যালেঞ্জ নেওয়া, দক্ষতা বাড়ানো, দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য কাজ করা—এসবই উৎসাহ-উদ্দীপনার ফল।

সহমর্মিতা একটা বিশেষ মানবীয় গুণ

৪. সহমর্মিতা (Empathy): কোনো ব্যক্তির পরিস্থিতিকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝতে পারা, তার চাহিদা ও প্রত্যাশা শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করা হলো সহমর্মিতা। পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য সহমর্মিতা একটা বিশেষ মানবীয় গুণ।

সামাজিক দক্ষতায় অন্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে

৫. সামাজিক দক্ষতা (Social Skills): সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ করা, অপরের অনুভূতি বুঝতে পারা, সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করা ও অপরের বক্তব্য বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দক্ষতা, যার মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার সঠিক ব্যবহারে সম্পর্কের উন্নতি

প্রতীকী ছবি

কোনো ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করার জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ভালো কাজের দক্ষতা বাড়ানো ও চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়, এমনকি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা যায় এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তার বিকাশ হতে পারে, যা মূলত ব্যক্তির নিজের উন্নতি ঘটাতে এবং অন্যের সঙ্গে সন্তোষজনক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সুতরাং, বন্ধু, সহকর্মী, পরিবার ও দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক উন্নতি ঘটাতে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার চর্চা প্রয়োজন। কিছু বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মসচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, উদ্দীপনা, সহমর্মিতা ও সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে। যেমন:

নিজেকে জানা: নিজের আচরণকে পর্যবেক্ষণ করে ও দোষ-গুণের বিশ্লেষণ করে নিজেকে জানা, পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে ও ইতিবাচক গুণাবলির যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে নিজের উন্নতির জন্য কাজ করা। এতে নিজেকে মূল্যায়ন করা যায়, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিকভাবে বোঝা যায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

অনুভূতি শনাক্ত করা: প্রচণ্ড আবেগীয় অবস্থায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে কিছু সময় বিরতি দিয়ে নিজের অনুভূতিগুলোকে শনাক্ত করা এবং অনুভূতিগুলো তৈরির পেছনের ট্রিগারগুলোর নোট রাখা। পরবর্তী সময়ে নিজের আচরণ বিশ্লেষণ করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করা, যা সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কখনো কারও অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকলে তার জন্য সরাসরি ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, মন থেকে সততার সঙ্গে ক্ষমা চাইলে মানুষ সাধারণত ক্ষমা করে দেয় এবং সম্পর্ক জোরালো হয়।

বিকল্প চিন্তা করা: কোনো বিষয়ে উত্তর জানা থাকার পরও নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে নানাবিধ বিকল্প উত্তর বা ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা। একই জিনিসের প্রতি ভিন্ন মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। সুতরাং, কারও নেতিবাচক আচরণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না করে ওই অবস্থার ভিন্ন ব্যাখ্যা খোঁজা, নিজেকে শান্ত করা ও পরবর্তী সময়ে অধিক কার্যকরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা।

মাইন্ডফুলনেস থেরাপি অনুশীলন কাজে দেয়

ফিডব্যাক গ্রহণ করা: সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ করে তা বিশ্লেষণ করা। ভুল কিছু হলে তা শুধরে নেওয়া। যৌক্তিক ও কার্যকরী ফিডব্যাকের মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ের উন্নতি করা যেতে পারে।

মাইন্ডফুলনেস থেরাপি অনুশীলন করা: মাইন্ডফুলনেস হলো বর্তমান মুহূর্তে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছুর ওপর মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করা এবং বিচারহীনভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা অনুভব করা। এভাবে নিজের চিন্তা ও অনুভূতিকে নিরপেক্ষভাবে বুঝতে পেরে নিজের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় ও অপরকে বুঝতে পারা যায়, যা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হয়ে থাকে।

রিলাক্সেশন অনুশীলন করা: হরমোন ও কেমিক্যালের উপস্থিতির কারণে মন ও দেহের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। তাই মানসিক চাপ ও উত্তেজনার ফলে দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, হাত-পা কাঁপা ইত্যাদি। অতি আবেগীয় অবস্থায় মস্তিষ্ক যৌক্তিক বিশ্লেষণ করতে পারে না বলে এ সময় ভুল সিদ্ধান্তগুলো বেশি নেওয়া হয়ে থাকে। রিলাক্সেশন ব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে মন ও দেহের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে এনে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

রিলাক্সেশন ব্যায়াম অনুশীলনে মন ও দেহের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়

আনন্দদায়ক কাজ করা: অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, ভালো কাজের প্রশংসা করা, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা ইত্যাদি ইতিবাচক কাজ অনুশীলনের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। সাধারণত ইতিবাচক আবেগীয় অনুভূতি উপভোগ করে এবং নেতিবাচক আবেগের প্রতি কম প্রতিক্রিয়া করে আত্মসন্তুষ্টি পাওয়া যায় ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতি করা যায়।

সহমর্মিতা প্রকাশ করা: বিচারের দৃষ্টিতে না দেখে কোনো ব্যক্তির অবস্থাকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে, অর্থাৎ তার মতো করে বোঝার চেষ্টা করা। তিরস্কারের পরিবর্তে সহমর্মিতা প্রকাশ করে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব।

মনোযোগী শ্রোতা হওয়া: যেকোনো বক্তব্য, এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী কোনো মতামতের ক্ষেত্রেও বাধা না দিয়ে মনোযোগের সঙ্গে শুনলে বক্তা ভালো অনুভব করে এবং শ্রোতা নিজেও তার চিন্তা ও আচরণগুলোর বিশ্লেষণ করে সঠিক মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়ে থাকে। ফলে উভয় ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বাড়ে এবং ভুল শুধরে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠার সম্ভাবনা থাকে।

অ্যাসারটিভ কমিউনিকেশন বিশেষ কার্যকর

অ্যাসারটিভ কমিউনিকেশন করা: যে কারও সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উভয়ের (অর্থাৎ, ব্যক্তির নিজের এবং যার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তার) প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, মনে আঘাত না দিয়ে, সহমর্মিতা প্রকাশ করে, অনুভূতিগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া করে, সরাসরি ও পরিষ্কারভাবে কথা বলা হলো অ্যাসারটিভ কমিউনিকেশন। এটা একটা বিশেষ সামাজিক দক্ষতা, যা যেকোনো সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইতিবাচক মনোভাব থাকা: সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা, অপরের সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা, শুধু নিজের উন্নতির জন্য কাজ না করে অপরের উন্নতির জন্যও কাজ করা, যা পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সহযোগিতা করে থাকে।

যেকোনো ব্যক্তি নিজের আবেগীয় অনুভূতিকে বুঝতে পারলে ও তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, সে অন্য ব্যক্তির অনুভূতিও শনাক্ত করতে পারবে, অন্যরা কেমন অনুভব করছে সেটা বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতে পারবে। এতে পারস্পরিক যোগাযোগ অনেক বেশি কার্যকর হবে। এ ছাড়া অ্যাসারটিভ কমিউনিকেশনের মাধ্যমে সরাসরি মনের ভাব প্রকাশ করে ভুল–বোঝাবুঝিরও অবসান হতে পারে। এভাবে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশে সামাজিক ক্ষেত্রে, তথা ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে।

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।