মানুষের হাড়ের গঠন শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকেই। তাই সন্তানের এবং নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একজন গর্ভবতী মাকে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করাটাও জরুরি। এতে ভালো থাকবে হাড় এবং কমবে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিও ।
মানুষকে অস্টিওপোরোসিস বিষয়ে সচেতন করতে ২০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘এসকেএফ অস্টিওপোরোসিস দিবস’। অনুষ্ঠানটির তৃতীয় পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল ‘সঠিক পুষ্টিতে মজবুত হাড়’। ডা. তেহরীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ডায়েট অ্যান্ড নিউট্রিশন কনসালট্যান্ট আয়শা সিদ্দিকা।
অনুষ্ঠানটি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আয়শা সিদ্দিকা গর্ভাবস্থায় মায়ের এবং ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেক মানুষের পুষ্টিকর খাবারে ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, অস্টিওপোরোসিসে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় দুর্বল হয়ে যায়। সহজেই ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী বয়স্ক মানুষজনের হাড় ভেঙে শয্যাশায়ী অবস্থা এবং কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ এই অস্টিওপোরোসিস। এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষদের চেয়ে নারীদেরই বেশি।
গর্ভাবস্থায় স্তন্যপান করানোর সময় এবং মাসিক বন্ধ হওয়ার পর নারীদের প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খেতে হবে। পাশাপাশি এ সময় প্রয়োজনে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডির সাপ্লিমেন্টও গ্রহণ করতে হবে। তবে ওষুধ গ্রহণে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ক্যালসিয়ামের সঙ্গে অবশ্যই ভিটামিন ডিও খেতে হবে, তা না হলে ক্যালসিয়াম থেকে উপকার পাওয়া যাবে সামান্যই।
আজকাল অবশ্য ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি একই সঙ্গে একই ট্যাবলেটের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ক্যালসিয়াম ও আয়রন ট্যাবলেট যেন একসঙ্গে খাওয়া না হয়। হয়তো দুপুরে আয়রন ট্যাবলেট খাচ্ছেন, সকালে ও রাতে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হবে। এ দুটি ওষুধ একই সঙ্গে খেলে আয়রন ট্যাবলেট থেকে খানিকটা কম উপকার পাওয়া যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় খাবার থেকে ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারলে।
এ জন্য দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যগুলো ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস। দুধ, দই, পনির, কাঁচা বাদাম, সয়াবিন, আখরোট, সামুদ্রিক মাছ, কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ, কালো ও সবুজ কচুশাক, শজনেপাতা, পুদিনাপাতা, শর্ষেশাক, কুমড়ার বীজ, সূর্যমুখীর বীজ, চিংড়ি শুঁটকি, ডুমুর ইত্যাদি হলো উচ্চ ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার।
আয়শা সিদ্দিকা আরও জানান, ১০০ গ্রাম দুধে ক্যালসিয়াম আছে ৯৫০ মিলিগ্রাম, একই পরিমাণ পাবদা মাছে ৩১০ মিলিগ্রাম, সামুদ্রিক মাছে ৩৭২ মিলিগ্রাম, শজনেপাতায় ৪৪০ মিলিগ্রাম, ট্যাংরা মাছে ২৭০ মিলিগ্রাম। এক কাপ টক দইয়ে থাকে আরও বেশি, ৪০০ মিলিগ্রামের মতো। আধা বাটি রান্না করা সবুজ পাতা আছে, এমন শাক খেলে ১০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়া হবে। এক গ্লাস কমলার রসে ১৫০ থেকে ২০০ মিলিগ্রাম।
এ ছাড়া যাঁদের ছোটবেলায় হাড়ের শক্তি ও ঘনত্ব ঠিকমতো বাড়েনি, তাঁরাই এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। তাই অল্প বয়সেই হাড়ের সর্বোচ্চ শক্তি ও ঘনত্ব অর্জনের জন্য সচেতন হতে হবে। নইলে বেশি বয়সে হাড়ভাঙার জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ছোটবেলা থেকেই পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কৈশোর থেকে নিয়মিত ব্যায়াম করা চাই। এতে হাড়ের শক্তি বাড়বে। মনে রাখতে হবে, আপনার হাড়ের ঘনত্ব কিন্তু নির্ধারিত হয়ে যায় ২০ বছর বা তার একটু বেশি বয়সেই। তাই হাড়ের যত্ন নিতে হবে তরুণ বয়সেই।
আলোচনার একপর্যায়ে আয়শা সিদ্দিকা দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরে এ-সংক্রান্ত নানা পরামর্শ দেন। সর্বোপরি তিনি গুরুত্ব দেন নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা ও ব্যায়ামের ওপর। তিনি জানান, হাড় হলো শরীরের মূল কাঠামো, অথচ হাড়ের গুরুত্ব আপাতদৃষ্টে আমরা বুঝতে পারি না। শুধু সমস্যা হলেই বুঝতে পারি। হাড়ের মূল উপাদান আমিষ, কোলাজেন ও ক্যালসিয়াম। একটু সচেতন হলেই হাড় মজবুত করে গড়ে তুলতে পারি।
আয়শা সিদ্দিকা বলেন, কিছু দৈনন্দিন অভ্যাসই পারে হাড়কে মজবুত করে তুলতে। যেমন হাঁটা, জগিং, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা এবং সব সময় কর্মক্ষম থাকা উচিত। স্বাদের কথা ভুলে গিয়ে নজর দিতে হবে পুষ্টির দিকে। কম চর্বিযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে প্রতিদিন। ডিম, কাঠবাদাম, মটরশুঁটি, ছোট মাছ, সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। পালংশাক, সবুজ শাক, বাঁধাকপি, ব্রকলি, লেটুস, শালগম ও শাকসবজিতে ভিটামিন কে, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম আছে, যা হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক্যালসিয়ামের সঙ্গে অবশ্যই ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে। ভিটামিন ডির সবচেয়ে বড় উৎস সূর্যের আলো। সপ্তাহে ৩ দিন ১০-১৫ মিনিট সূর্যের আলো লাগাতে হবে পুরো দেহে। কেননা, শরীরে ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকলে খাবারের মাধ্যমে যে ক্যালসিয়াম দেহে নেওয়া হয়, তা হাড়ের দ্বারা শোষিত হবে না এবং ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরও হাড়ের সমস্যা দূর হবে না। এর অভাব পূরণে মাছ, মাছের তেল, দুধ, সয়া দুধ ও ফলমূল খেতে হবে। চিংড়ি, টুনা, কমলার রস, ডিমের কুসুমেও ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে।