>১১৭ বার স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহিম। ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে তাঁর কথাই থাকছে প্রতিবেদনে
উচ্চমাধ্যমিক নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল তাঁর। মেধাবী ছাত্র হিসেবে যে নামডাক, তারই প্রমাণ রাখছিলেন খাতায়। পরীক্ষার ঘণ্টা দেড়েক পার হয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে এক বন্ধু এলেন সোজা পরীক্ষার হলে। জানালেন বোনের অবস্থা সংকটাপন্ন, িব–পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। ধন্দে পড়লেন মোহাম্মদ আবদুর রহিম। স্কুলে পড়ার সময় রক্তের গ্রুপ জেনেছিলেন, কিন্তু রক্ত দান করা হয়নি তখনো। ভাবলেন, আগে মানুষের জীবন। শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে ছুটে গেলেন রক্ত দিতে।
১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জীবনে প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদানের অভিজ্ঞতা শুনি আবদুর রহিমের মুখে, ‘এরপর নিয়ম মেনে আমি রক্ত দিতে থাকলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সন্ধানীর সঙ্গে কাজ শুরু করলাম।’ স্বেচ্ছায় রক্তদানের সেই কাজ এখনো অব্যাহত রেখেছেন আবদুর রহিম। নিজে যেমন রক্ত দান করেছেন, তেমনি অনুপ্রাণিত করছেন আশপাশের মানুষদেরও। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১১৭তম বারের মতো রক্ত দান করেছেন আবদুর রহিম।
বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই আবদুর রহিম পেশায় কলেজশিক্ষক। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজে দর্শন বিষয়ে পড়ান। তিনি বললেন, ‘আমি সম্মান বা স্বীকৃতির জন্য রক্ত দিইনি। মানুষের উপকারে আসার তাগিদ থেকেই কাজটি করি।’
মানুষের উপকারে আসার তাগিদ তিনি পেয়েছেন ছোটবেলায়। দিনে দিনে তাঁর ধ্যানজ্ঞান যেন হয়ে উঠল মানবসেবা। কখনো ছুটে যান রক্ত দিতে, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন রক্তদানে, পাশে দাঁড়ান অসহায় মানুষের সাহায্যে।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সরাসরি পড়িয়েছি এমন ৪০০ জনের রক্তের গ্রুপ আর ফোন নম্বর আমার সংগ্রহে আছে। তারা আমার মাধ্যমে রক্তদানে উৎসাহিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকলেও এখনো বিভিন্ন সময় রক্তের প্রয়োজনে তাদের ফোন করি। তারাও খুশিমনে রক্ত দেয়।’
শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রতিদিন নতুন রক্তদাতা তৈরি করার বিষয়টিকে আবদুর রহিম দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি সহস্রাধিক নতুন রক্তদাতা তৈরিও করেছেন। নিজেও যুক্ত হয়েছেন জাতীয় ও স্থানীয় অনেক সংগঠনের সঙ্গে। তেমনি রক্তদাতাদের একটি জাতীয় সংগঠন ‘রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত দেব তাঁর সম্পর্কে বলছিলেন, তিনি নিজে শুধু নিয়মিত রক্ত দেন, ব্যাপারটা এমন নয়। মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে আগ্রহী করতে তাঁর কাজের পরিধি আরও বিস্তৃত। নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজের মধ্যে অসহায় মানুষের পাশেও দাঁড়ান।
এসব কাজের জন্য দাগনভূঞা উপজেলা প্রশাসনের গুণীজন সম্মাননাসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
তূর্য ক্লাবে স্বপ্ন বোনা
নোয়াখালীর হাতিয়ায় ছিল আবদুর রহিমদের আদি বাড়ি। মেঘনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হািরয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চলে আসেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায়। আবদুর রহিমের বাবা ছোটখাটো একটা চাকরি করতেন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হন রহিম। নিম্নমাধ্যমিকে পড়ার সময় দেখেন, বইয়ের অভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য পুরাতন বই সংগ্রহ করে দিতেন।
১৯৮৮ সালে কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু স্কুলের উদ্যোগটা এগিয়ে নিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করেন তূর্য ক্লাব। এই ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল সদস্যদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং পুরাতন বই গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা। মানুষের সেবা করা শুরু সেই থেকে।
আবদুর রহিমের কাজে সমর্থন আছে তাঁর শিক্ষিকা স্ত্রী আর কলেজপড়ুয়া একমাত্র মেয়েরও। রহিম বলছিলেন, ‘রক্ত দিতে গিয়ে অনেক মানুষের হৃদয়ে জায়গা পেয়েছি, অনেকে এখনো খোঁজ নেন, আপনজন ভাবেন। এক জীবনে এর চেয়ে আর কীই-বা পাওয়ার আছে।’