শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, বয়সভেদে বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী বা নতুন মায়েদের ৫০ শতাংশ পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত। ইদানীং শিশু-কিশোরেরাও এই সমস্যায় ভুগছে। করোনাকালে এই সমস্যা আরও বেড়েছে।
ঘুমের সময় হওয়ার পরও যখন কোনো ব্যক্তির সহজে ঘুম আসে না, কিংবা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, ঘুমালেও কিছুক্ষণ পর ভেঙে যায়, এরপর আর ঘুম আসতে চায় না—এ রকম সমস্যায় প্রায়ই বা প্রতিনিয়ত ভুগতে থাকাকেই ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা বলে ধরে নেওয়া হয়। সাধারণত এটি তিন ধরনের হয়ে থাকে:
১. হঠাৎ কোনো এক রাত ঘুমহীন কাটানো বা মাসের মাঝেমধ্যে ঘুমের সমস্যা পরিলক্ষিত হওয়া। এ ধরনের অনিদ্রার জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। কখনো নিজস্ব দৈনিক রুটিনের ব্যত্যয় হলেও এমন হতে পারে।
২. এক সপ্তাহে অনধিক তিন রাত নিদ্রাহীন কাটানো। এ ধরনের অসুবিধা কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ও কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ সেবন করলে ঠিক হয়ে যায়।
৩. দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা বা পর্যাপ্ত সুনিদ্রার অভাব। এ ক্ষেত্রে রোগীরা অন্তত তিন মাস ধরে সপ্তাহে তিন বা ততোধিক রাত অনিদ্রার যন্ত্রণায় কষ্ট পান। এ রকম অবস্থার বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। তাই সমাধানের বেলায়ও মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইনসমনিয়ার কারণ
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতায় ভোগা, মানসিক অস্থিরতা।
শরীরে হরমোনের পরিবর্তন।
ব্যক্তিগত জীবনে কলহ কিংবা পারিবারিক, সামাজিক বা চাকরিক্ষেত্রে কোনো বিষয় নিয়ে বিষণ্ন অথবা বিচলিত থাকা।
জীবনধারায় শৃঙ্খলার অভাব।
মাদক সেবন।
কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক রোগের উপসর্গ হিসেবেও অনিদ্রা হতে পারে।
অনিদ্র বা সুনিদ্রার অভাব দিনের পর দিন চলতে থাকলে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, সুস্থতার জন্য সঠিক পুষ্টির মতো সঠিক ঘুমও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইনসমনিয়ার সঙ্গে কিছু রোগবালাই সরাসরি সম্পর্কিত। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রত্যেকের জন্য রাতে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক বলে ঘোষণা দিয়েছে।
ইনসমনিয়ার কারণে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে তা হলো শারীরিক দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, আচরণজনিত সমস্যা, মেজাজ রুক্ষ হয়ে যাওয়া কিংবা মনমরা ভাব থাকা, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া। এর কারণে মানুষ দিনের বেলার স্বাভাবিক কাজকর্মে গতি হারায়। জীবনমানের অবনতি ঘটে।
পর্যাপ্ত সুনিদ্রার জন্য কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঘুম না হলেই যে ঘুমের বড়ি খেতে হবে, বিষয়টা তা নয়। স্লিপ হাইজিন বলে একটা ব্যাপার আছে, যা মেনে চললে হারানো ঘুম অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখবেন, ইনসমনিয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, এর প্রতিকার দরকার। তাই প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো আবশ্যক। যাঁরা রাত্রিকালীন কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাঁদের দিনের বাকি সময়ের মধ্যে এই কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে হবে।
সুষম খাবার গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত (যেমন সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ) আধঘণ্টা করে হলেও হাঁটা বা শরীরচর্চা করা উত্তম। তবে রাতে ঘুমানোর আগে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে কোনোরূপ ব্যায়াম না করাই শ্রেয়।
দৈনিক একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এমনকি ছুটির দিনেও।
ঘরের তাপমাত্রা, শোবার বিছানা ও ঘুমের পরিবেশ যেন সুনিদ্রাসহায়ক হয়, তা খেয়াল রাখুন।
ঘুমের সময় সারা দিনের সব কাজ, সমস্যা, ঘটনা কিংবা পরদিনের জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকবেন।
ঘুমের আগে মুঠোফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার, টিভি দেখা, গেমস খেলা পরিহার করুন।
মদ্যপান, চা-কফি, চকলেট—এ-জাতীয় খাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
দিনের বেলা ২০ মিনিটের বেশি না ঘুমানোই ভালো।
ঘুম না এলে বারবার ঘড়ি দেখা কিংবা এটা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়া বা এ জন্য ঘুমের ওষুধ হিসেবে যেকোনো কিছু খেয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা মানবদেহে বিভিন্ন গুরুতর জটিলতার জন্য দায়ী। কারও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
অপর্যাপ্ত ঘুমের ধরন ও তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা যেতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাউন্সেলিংয়ে উপকার পাওয়া যায়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা