আজ আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এ উপলক্ষে পড়ুন এক নারীর গল্প, যিনি মাদকের সঙ্গে লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
ঘটনাটি সত্য। শুধু পরিচয় গোপন রাখতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
সদ্য মাস্টার্স করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন রুবিনা। পরিবার থাকে গ্রামের বাড়িতে। ঢাকায় তিনি একা। চাকরিসূত্রেই নজরুলের সঙ্গে রুবিনার পরিচয়। নজরুল তাঁর সমবয়সী, ব্যবসায়িক কাজে রুবিনার অফিসে আসেন। দ্রুত দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রুবিনাকে একদিন বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে যান নজরুল। যেখানে সমবয়সী কয়েক তরুণ–তরুণী আড্ডা দিচ্ছিলেন। নজরুলসহ সেই তরুণ–তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের মাদক নিচ্ছিলেন। রুবিনাকেও তাঁরা মাদক নিতে উৎসাহিত করেন। রাজি না হওয়ায় বাকিরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন। রুবিনার মন খারাপ হয়। পরদিন তিনি নজরুলকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এসব কী?’ নজরুল বললেন, ‘জাস্ট ফান।’ কথায় কথায় সেদিন নজরুল বুঝিয়ে দিলেন, তাঁদের সঙ্গে চলতে হলে মাঝেমধ্যে এসব খেতে হবে। রুবিনার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু দিন কয়েক পরে আরেক আড্ডায় নজরুলসহ বাকিদের চাপে মাদক নিতে বাধ্য হলেন রুবিনা। তাঁর মনে ভয়, না নিলে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে।
সেই শুরু। মাস ছয়েকের মধ্যে রুবিনার এমন অবস্থা হলো যে নিজ থেকেই নজরুলের কাছে মাদকের বায়না ধরতেন। প্রথমে বিনা মূল্যে দিলেও একপর্যায়ে দামের কথা বলে রুবিনার কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করলেন নজরুল। সরাসরি মাদক বিক্রেতার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর রুবিনার আচরণে পরিবর্তন চলে এল। অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠানোও কমিয়ে দিলেন। রুবিনার কাছের এক বান্ধবী বিষয়টি শুরু থেকে লক্ষ করেছিলেন। অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় সেই বান্ধবী একদিন জোর করে রুবিনাকে নিয়ে গেলেন মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে।
যেভাবে ফিরে এলেন
মনোরোগ চিকিৎসক সবকিছু শুনে রুবিনাকে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে রুবিনা ভর্তি হতে চাইলেন না। এমনকি বাসাতেও কিছু জানাতে চাইলেন না। মনোরোগ চিকিৎসক রুবিনার সবদিক বিবেচনা করে তাঁর সেই বান্ধবীকে জানালেন, কিছু নির্দেশনা মেনে চললে ভর্তি না হয়েও সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন রুবিনা।
চিকিৎসকের নির্দেশনাগুলোর অন্যতম ছিল মাদক গ্রহণকারী সঙ্গী আর মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। প্রয়োজনে মুঠোফোন নম্বর বদলে ফেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ডিঅ্যাকটিভেট করে দেওয়া। রুবিনা দিন–রাতের যে সময়ে মাদক নিতেন, সে সময়ে মাদক নেন না, এমন বন্ধুদের সঙ্গে থাকা। মাদক গ্রহণের স্থানগুলো এড়িয়ে চলা। নিয়মিত চিকিৎসক আর সাইকোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।
সবকিছু মানতে রাজি রুবিনা। মন থেকেই মাদক থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিলেন তিনি। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা শুরু করলেন। চিকিৎসক কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ দিলেন। সেগুলোও খেতে লাগলেন। এর মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল রুবিনার অফিস কর্তৃপক্ষ। একদিন সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে রুবিনার সঙ্গে এলেন তাঁর দুজন সহকর্মী। তাঁরা জানালেন, অফিসের বস রুবিনার বিষয়টি জেনেছেন। তাঁর চিকিৎসায় তাঁরাও সাহায্য করতে চান। রুবিনার চাকরিতেও কোনো সমস্যা হবে না। আর নজরুল যেন কোনোভাবেই রুবিনাকে বিরক্ত না করেন, সে বিষয় তাঁরা নিশ্চিত করবেন।
কাছের মানুষ, সহকর্মী, অফিস আর চিকিৎসকদের দেড় বছরের চেষ্টায় রুবিনা সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত আর সুস্থ। এখনো অফিসে তাঁর প্রমোশন হয়নি, এটা নিয়ে তিনি একটু চিন্তায় আছেন। তবে অফিস রুবিনাকে অন্য একটি দায়িত্ব দিয়েছে—অফিসে প্রতি মাসে মাদকবিরোধী ও লাইফস্টাইল মডিফিকেশন নিয়ে আলোচনার আয়োজন। এটা করতে পেরেই নিজেকে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে করছেন রুবিনা। আর হ্যাঁ, অফিসের বস এরই মধ্যে মনোরোগ চিকিৎসককে জানিয়েছেন, নতুন বছরে পদোন্নতিও পেতে পারেন রুবিনা।