মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনেক সময় মনে করা হয় জিনে আসর করেছে। এটি প্রচলিত কুসংস্কার। মৃগীরোগে পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত এবং গুরুতর স্নায়ুজনিত একটি রোগ, যা মস্তিষ্কের একটি অংশ অথবা পুরো মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে। এপিলেপসি বা মৃগীজনিত খিঁচুনি হয়। কোনো ব্যক্তির একবার খিঁচুনি হওয়া মানে এই নয় যে তার মৃগীরোগ আছে। মৃগীরোগ তখনই বলা হবে, যখন চিকিৎসক মনে করবেন রোগীর একাধিকবার বা বারবার খিঁচুনি হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেকোনো বয়সে এ রোগ শুরু হতে পারে। কিছু সাময়িক আবার কিছু আজীবন স্থায়ী হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ এপিলেপসি বা মৃগীরোগী আছে। যাদের বয়স ১৬ থেকে ৩১ বছরের মধ্যে।
সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে মস্তিষ্কে আঘাত, সংক্রমণ, প্রদাহ, মস্তিষ্কে টিউমার, স্ট্রোক, জিনগত কারণ ইত্যাদি। প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা ধারণা করা হয় যে কার মৃগীরোগ হবে, এটা নির্ণয় করতে জিন একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
আমাদের মস্তিষ্কে সব সময়ই বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ঘটে থাকে। হঠাৎ করে মস্তিষ্কে তীব্র বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের বিস্ফোরণ হলে খিঁচুনি হয়। খিঁচুনি বিভিন্ন প্রকার এবং তা নির্ভর করে রোগীর মস্তিষ্কের কোন অংশ প্রভাবিত হয়েছে তার ওপর। খিঁচুনির আগে অস্বাভাবিক অনুভূতি হতে পারে। খিঁচুনির সময় রোগী সজাগ থাকতে পারে আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, রোগীর শরীর শক্ত হয়ে যেতে পারে, অস্বাভাবিক ঝাঁকুনি দেখা দিতে পারে, জিবে কামড় লাগতে পারে, এমনকি পায়খানা বা প্রস্রাব হয়ে যেতে পারে।
মৃগীরোগ নির্ণয় নির্ভর করে খিঁচুনির ধরনের ওপর। অনেক সময় রোগী বলতে না পারলেও কোনো ব্যক্তি, যিনি খিঁচুনি হতে দেখেছেন, তাঁর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। সাধারণত ইইজি, মস্তিষ্ক স্ক্যান ও রক্তের কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। এই পরীক্ষাগুলোর ওপর ভিত্তি করে মৃগীরোগের প্রকার বা কারণ নির্ণয় করা যায়। কিন্তু কোনো একক পরীক্ষা প্রমাণ করতে পারে না আপনার মৃগীরোগ আছে কি নেই। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেন।
মৃগীরোগের প্রধান চিকিৎসা হলো ওষুধ, যা অ্যান্টি–এপিলেপটিক ড্রাগ নামে পরিচিত। এই ওষুধগুলো মৃগীরোগ পুরোপুরি নিরাময় করে না, কিন্তু খিঁচুনি বন্ধ করতে সাহায্য করে বা খিঁচুনির প্রকোপ কমায়। কোন ধরনের ওষুধ লাগবে, তা নির্ভর করে মৃগীরোগের ধরন, বয়স ও লিঙ্গের ওপর। অনেক সময় ওষুধ বন্ধ করা যায়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ওষুধ সেবন করতে হয়। চিকিৎসককে না জিজ্ঞাসা করে কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। ওষুধ ছাড়াও মৃগীরোগের বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি আছে। যেমন বিশেষ ধরনের খাদ্যতালিকা, এপিলেপসি সার্জারি ইত্যাদি।
নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। ওষুধ অনিয়মিত খেলে বা মাত্রা ভুল হলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিছু বিষয় খিঁচুনি ঘটাতে পারে, যা ট্রিগার নামে পরিচিত। যেমন ঘুম কম হওয়া, অতিরিক্ত চাপ, দপদপ করছে বা জ্বলছে এমন আলো, যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ, অতিরিক্ত মদ্যপান ইত্যাদি। ট্রিগারের সংখ্যা কমাতে পারলে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। একটি ডায়েরি রাখুন, খিঁচুনির প্রতিটি ঘটনা টুকে রাখার জন্য, এতে পূর্বাপর কোন বিষয়টি ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে বোঝা সহজ হবে। মৃগীরোগীদের বিষণ্নতা, একাকিত্ব, বিষাদগ্রস্ততা হতে পারে। এমন কিছু হলে চিকিৎসককে জানান।
গর্ভধারণের ক্ষেত্রে মৃগীরোগ কোনো বাধা নয়। অধিকাংশ নারীর স্বাভাবিক গর্ভধারণ হয় এবং তাঁরা সুস্থ শিশু জন্মদান করে থাকেন। কিন্তু পরিকল্পিত জন্ম ধারণ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা খুব জরুরি। তা ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ওষুধ পরিবর্তনের দরকার হতে পারে। যদি অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়েন, ওষুধ বন্ধ করবেন না এবং যত শিগগির সম্ভব আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
খিঁচুনি বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, তাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। যেমন এ ধরনের রোগীর একা পুকুর বা পুলে গোসল করা, গাছে ওঠা, ছাদের কিনারে বসা, আগুন নিয়ে খেলা, অর্থাৎ যেসব কাজ করার সময় খিঁচুনি হলে জীবনের ঝুঁকি হতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। খিঁচুনির কারণে মৃত্যুও হতে পারে এবং খিঁচুনির কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েও মৃত্যু হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এপিলেপসি রোগীর মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায় না। এই ঘটনাকে বলে এপিলিপসিতে আকস্মিক অপ্রত্যাশিত মৃত্যু (এসইউডিইপি)।
যদি খিঁচুনি হয়, তবে আপনার গাড়ি চালানো অবশ্যই বন্ধ রাখা উচিত। এটি করা উচিত নিজেকে এবং রাস্তার মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। ড্রাইভিং লাইসেন্স ফিরে পেতে বিভিন্ন রকম নিয়ম প্রযোজ্য, যা খিঁচুনির প্রকার ভেদে বিভিন্ন রকম।
প্রথমেই রোগীকে বিপজ্জনক জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলুন। রোগীকে ধরে বাম কাত করে দিন, যাতে মুখের ফেনা নিঃসরণ ইত্যাদি গড়িয়ে বাইরে পড়তে পারে। আতঙ্কিত হবেন না। খিঁচুনি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত রোগীর সঙ্গে থাকুন। রোগীর খিঁচুনি থামানোর কোনো চেষ্টা করবেন না নিজে থেকে। মুখে কিছু ঢোকানো, জুতার গন্ধ শোঁকানো, মুখে খাবার বা পানি দেওয়ার চেষ্টা, রোগীকে ঝাঁকানো ইত্যাদি করা যাবে না। অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন বা হাসপাতালে নিন। খিঁচুনি থেমে গেলেও নিতে হবে, কারণ আবার হতে পারে।
লেখক, সহকারী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।