পর্ব ০৬

মৃগীরোগের সতর্কতা ও স্বজনদের করণীয়

মৃগীরোগ কিশোর বা তরুণ বয়সে বেশি হয়ে থাকে। ইডিওপ্যাথিক কজ এপিলেপসি বা মৃগীরোগ ২০ বছরের আগে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ মৃগীরোগী আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ রোগীর বয়স ১৩ থেকে ৩১ বছর। এ রোগ ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে হতে পারে। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের কিছুটা বেশি হয় এই রোগ।

আমাদের দেশে নানা ধরনের কুসংস্কারের জন্য মৃগীরোগীরা অনেক বঞ্চনা-গঞ্জনার শিকার হয়। এমনকি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক আচরণ পেয়ে থাকে। সমাজে তাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখা হয়, যা মোটেও ঠিক নয়। এ নিয়েই আলোচনা হলো আন্তর্জাতিক মৃগীরোগ দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘এসকেএফ নিবেদিত মৃগীরোগ সচেতনতা সপ্তাহ’-এর ষষ্ঠ পর্বে। এবারের বিষয়: মৃগীরোগের সতর্কতা ও স্বজনদের করণীয়।

ডা. লুবাইনা হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী। অনুষ্ঠানটি ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী মৃগীরোগ কী, তা নিয়ে আলোচনা করেন। মৃগীরোগ স্নায়ুতন্ত্রের একটি দীর্ঘকালীন রোগ। এটি অনেক প্রাচীন একটি রোগ। যদিও একে অনেকে জিন-ভূতের আসর বলেন, যা একটি ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। মস্তিষ্কের এক জায়গা থেকে অথবা সম্পূর্ণ অংশে অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের জন্য শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এ অবস্থাই মৃগীরোগ।

মৃগীরোগ হওয়ার কারণ বয়সভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ডাক্তারি ভাষায় একে ইডিওপ্যাথিক কজ বলে। ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী বলেন, ছোটদের ক্ষেত্রে কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও ২০ বছরের বেশি বয়স যাঁদের, তাঁদের বেশ কিছু কারণে মৃগীরোগ হতে পারে। যেমন ব্রেন টিউমারের জন্য হতে পারে, স্ট্রোকের পরে হতে পারে, ব্রেনে কোনো ইনফেকশনের জন্য, কারও রক্ত, লিভার, কিডনিতে গ্লুকোজ বা শরীরে লবণ বেড়ে বা কমে গেলে অনেক সময় মৃগীরোগ বা খিঁচুনি হতে পারে।

মৃগীরোগ কিশোর বা তরুণ বয়সে বেশি হয়ে থাকে। ইডিওপ্যাথিক কজ এপিলেপসি বা মৃগীরোগ ২০ বছরের আগে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ মৃগীরোগী আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ রোগীর বয়স ১৩ থেকে ৩১ বছর। এ রোগ ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে হতে পারে। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের কিছুটা বেশি হয় এই রোগ।

মৃগীরোগ অন্যান্য রোগের মতোই একটি রোগ, যার এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে নিয়ম মেনে চিকিৎসা করালে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় করা সম্ভব। সুতরাং আপনার শিশুর মৃগীরোগ মানেই সে প্রতিবন্ধী নয়। তাকে অবশ্যই স্বাভাবিক শিশুদের মতো চলাফেরা করতে দিতে হবে। খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে। সাধারণ স্কুলেই পড়াশোনা করবে। স্কুলের শিক্ষকদের জানাতে হবে যে আপনার শিশুর মৃগীরোগ আছে।
ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী, সহযোগী অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল

আমাদের দেশে শিশু বা কিশোর বয়সে মৃগীরোগ বেশি হয়, যাদের বেশির ভাগ স্কুলের ছাত্রছাত্রী। অনেক সময় দেখা যায়, স্কুলে সিজার অ্যাটাক হলে শিক্ষকেরা রিপোর্ট করেন। অভিভাবকেরা এ নিয়ে বিব্রতবোধ করেন। অনেক মা–বাবারা আবার এটি ভেবে বসে থাকেন যে তাঁর শিশু শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী। এই অভিভাবকদের উদ্দেশে মোহাম্মদ সেলিম শাহী বলেন, ‘মৃগীরোগ অন্যান্য রোগের মতোই একটি রোগ, যার এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে নিয়ম মেনে চিকিৎসা করালে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় করা সম্ভব। সুতরাং আপনার শিশুর মৃগীরোগ মানেই সে প্রতিবন্ধী নয়। তাকে অবশ্যই স্বাভাবিক শিশুদের মতো চলাফেরা করতে দিতে হবে। খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে। সাধারণ স্কুলেই পড়াশোনা করবে। স্কুলের শিক্ষকদের জানাতে হবে যে আপনার শিশুর মৃগীরোগ আছে।

শিশু যাতে ঝুঁকিতে না থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, প্রতিবার খিঁচুনি হওয়া মানে ব্রেনের কিছু নিউরন ড্যামেজ হওয়া। বারবার খিঁচুনি হলে শিশুর বুদ্ধি বা জ্ঞান কিছুটা কমে আসতে পারে।

প্রয়োজনে একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে রাখতে হবে। শিশুর ডায়েরি বা পকেটে অভিভাবকদের ফোন নম্বর দিয়ে রাখতে হবে, যাতে অসুস্থ হলে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। দরকার হলে স্কুলব্যাগে ওষুধের লিস্ট বা ওষুধ রাখতে হবে, যাতে জরুরি মুহূর্তে সেটি সেবন করা যায়। এটি শুধু ছোটদের ক্ষেত্রে নয়, বড়দেরও এভাবে সতর্ক হতে হবে। এর পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে, যাতে শিশুর চিকিৎসা বারবার করাতে না হয়। শিশু যাতে ঝুঁকিতে না থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, প্রতিবার খিঁচুনি হওয়া মানে ব্রেনের কিছু নিউরন ড্যামেজ হওয়া। বারবার খিঁচুনি হলে শিশুর বুদ্ধি বা জ্ঞান কিছুটা কমে আসতে পারে।’

চিকিৎসকেরা খিঁচুনির সময় আশপাশে আত্মীয়স্বজন থাকলে তাদের ওই অবস্থাটা ভিডিও করে রাখতে বলেন। কারণ, মৃগীরোগের অনেক ধরন আছে। যেমন কারও হঠাৎ একপাশ শক্ত হয়ে যায়। আবার কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়, পড়াশোনা বা কাজের সময় হঠাৎ চোখে মেলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডাক দিলে সাড়া দেয় না। আবার দেখা যায়, কেউ হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কোনো কারণ ছাড়াই হাসতে থাকে বা কাঁদতে থাকে কিংবা রাগারাগি করে। রোগীরা বুঝতেই পারে না, ওই সময় তারা কী করছে। মৃগীরোগের এই বিভিন্ন লক্ষণ দেখে তার ধরন নির্ধারণ করতে হয়।

ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহীর আলোচনা থেকে জানা গেল, হিস্টেরিয়া নামের একধরনের মানসিক রোগ আছে, যা অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন্য হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণ অনেকটা মৃগীরোগের লক্ষণের মতো। যেমন হঠাৎ হাত-পা ঝাঁকুনি বা কাঁপুনি দিয়ে ওঠা। তাই অনেকে মৃগীরোগের সঙ্গে হিস্টেরিয়াকে গুলিয়ে ফেলেন। সারা বিশ্বে এমন অনেক হিস্টেরিয়ার রোগী আছে, যারা মৃগীরোগী হিসেবে চিকিৎসা পাচ্ছে। এ জন্য সিজার অ্যাটাকের মুহূর্তের ভিডিও থাকলে তা–ই দেখে চিকিৎসকেরা ধারণা করতে পারবেন যে রোগী মৃগীরোগে নাকি হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত।

হিস্টেরিয়া নামের একধরনের মানসিক রোগ আছে, যা অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন্য হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণ অনেকটা মৃগীরোগের লক্ষণের মতো। যেমন হঠাৎ হাত-পা ঝাঁকুনি বা কাঁপুনি দিয়ে ওঠা। তাই অনেকে মৃগীরোগের সঙ্গে হিস্টেরিয়াকে গুলিয়ে ফেলেন।

মনে রাখতে হবে, মৃগীরোগ সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধরা যায় না। তাই ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের জন্য এই ভিডিও ক্লিপ আর রোগীর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে দেখা যায়, বিয়ের সময় মেয়ের মৃগীরোগ আছে—কথাটি লুকিয়ে যান অভিভাবকেরা। পরে শ্বশুরবাড়িতে গেলে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিলে বারবার খিঁচুনি হতে পারে। এতে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ নিয়ে ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানাতে হবে এবং নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।

গর্ভ ধারণ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, কিছু ক্ষেত্রে মৃগীরোগ গর্ভধারণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যে ওষুধ সেবন করা হয়, তাতে শিশুর সমস্যা হতে পারে। তাই গর্ভধারণের অন্তত ছয় মাস আগে চিকিৎসককে জানাতে হবে, যাতে তাঁরা এমন ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন, যা রোগী ও শিশুর জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। আর যাঁরা নববিবাহিত, তাঁদের জন্মবিরতিকরণ ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করতে হবে। কারণ, কিছু ওষুধের অ্যাস্ট্রোজেন হরমোনের জন্য মৃগীরোগের ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়।

গর্ভ ধারণ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, কিছু ক্ষেত্রে মৃগীরোগ গর্ভধারণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যে ওষুধ সেবন করা হয়, তাতে শিশুর সমস্যা হতে পারে। তাই গর্ভধারণের অন্তত ছয় মাস আগে চিকিৎসককে জানাতে হবে, যাতে তাঁরা এমন ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন, যা রোগী ও বাচ্চার জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। আর যাঁরা নববিবাহিত, তাঁদের জন্মবিরতিকরণ ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করতে হবে।

মৃগীরোগীদের আরও কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন আগুনের কাছে যাওয়া, সাঁতার কাটা এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, আগুন ও পানি খিঁচুনি বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার মুঠোফোন ও টিভির ফ্লিকারিং লাইট খিঁচুনি বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ধরনের জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। একটানা অনেকক্ষণ মুঠোফোন বা টিভি ব্যবহার না করা ভালো। আর ড্রাইভিং করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।