মামুলি মাথাব্যথাও সর্বনাশের কারণ হতে পারে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মাথাব্যথাকে আমরা অনেকে খুব সাধারণ একটা সমস্যা মনে করে হেলাফেলা করি। কিন্তু মামুলি মাথাব্যথাও হতে পারে সর্বনাশের কারণ। কোন ধরনের ব্যথা বিপজ্জনক সে সম্পর্কে আলোচনা হলো ‘মাইগ্রেইন ও মাথাব্যথা নিয়ে সচেতনতা সপ্তাহ’ উপলক্ষে আয়োজিত এসকেএফ নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মাথা নিয়ে মাথাব্যথা’র পঞ্চম পর্বে। এ পর্বের প্রতিপাদ্য ‘মাথাব্যথা যখন বিপজ্জনক রোগের কারণ’। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু নাইম। পর্বটি সঞ্চালনা করেন ডা. শ্রাবন্য তৌহিদা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

শতকরা ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগ মাথাব্যথাই প্রাথমিক পর্যায়ের মাথাব্যথা। অর্থাৎ কোনো কারণ ছাড়াই হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ব্যথা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ হতে পারে।

শুরুতেই জানা যায় শতকরা ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগ মাথাব্যথাই প্রাথমিক পর্যায়ের মাথাব্যথা। অর্থাৎ কোনো কারণ ছাড়াই হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ব্যথা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ হতে পারে। কিছু মাথাব্যথার ধরন বা লক্ষণ থাকে যা দেখে চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নেন যে রোগীর আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা লাগবে কি না। এই লক্ষণগুলোকে ডাক্তারি ভাষায় ‘রেড ফ্ল‍্যাগ সাইন’ বলে। যেমন হঠাৎ মাথায় বজ্রাঘাতের মতো তীব্র ব্যথা, ব্যথার সঙ্গে ঘাড়ব্যথা বা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া; ঘনঘন বমি বা বমি বমি ভাব হওয়া, খিঁচুনি, চোখে ঝাপসা দেখা, অজ্ঞান বা শরীরের এক পাশ ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার মতো আচরণ করা ইত্যাদি।

এ ছাড়া পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তির নতুন করে মাথাব্যথা, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যয়াম, হাঁটাচলা এমনকি হাঁচি–কাশির পর ব্যথা বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপের রোগীর মাথাব্যথা, কোনো রোগে আক্রান্ত রোগীর হঠাৎ মাথাব্যথা, কোনো সময় মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাথাব্যথা, ইম্যুনসাপ্রেসিভ ড্রাগ অর্থাৎ যেসব ওষুধ মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, সেই ধরনের ওষুধ সেবনকারী রোগীর মাথাব্যথা—এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

ডা. শ্রাবন্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ডা. আবু নাইম

এ ধরনের উপসর্গের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা রোগীর তথ্য এবং রোগের ইতিহাস জেনে শারীরিক পরীক্ষা করে থাকেন। প্রথমে রোগীর রুটিন টেস্ট করা হয়। যেমন ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি টেস্ট। এই টেস্টে যদি দেখা যায় রোগীর রক্তে শ্বেতকণিকা বেড়ে গেছে তাহলে ধরে নিতে হবে ব্যথাটা জ্বরজনিত কারণে হচ্ছে। আবার যদি ইএসআর বেড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে মাথার ভেতরে কোনো ধরনের ইনফেকশন। ব্লাড টেস্ট ছাড়াও এক্স–রে ও আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়। এতে যদি শরীরের কোথাও টিউমার ধরা পড়ে তাহলে ধরে নিতে হবে মাথার ভেতরেও টিউমার হয়েছে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শরীরের কোনো টিউমার ধরা পড়লে মাথার ভেতর সেকেন্ডারি একটি বা তার অধিক টিউমার হওয়ার শক্ত সম্ভাবনা থাকে।

ব্রেইন টিউমারের সাধারণ লক্ষণই হচ্ছে মাথাব্যথা। রুটিন টেস্টে কিছু ধরা না পড়লে দ্বিতীয় পর্যায় গিয়ে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ফান্ডোসকপির (চোখের পরীক্ষা) মতো ইমেজিং টেস্ট করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কোনো সমস্যা ধরা পড়লে সেই অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ব্রেইন টিউমার, মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া, মস্তিষ্কের পর্দা বা মেনিনজেস প্রদাহ বা মস্তিষ্কের প্রদাহ ধরা পড়লে সাধারণত রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।

এই চিকিৎসা দুরকমের হয়ে থাকে। অপারেশন ছাড়া এবং অপারেশনজনিত চিকিৎসা। রোগীর অবস্থা বুঝে অপারেশন করা হবে কি না, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন মেনিনজেস প্রদাহ বা মেনিনজাইটিস হলে অপারেশন করা লাগতেও পারে আবার না–ও লাগতে পারে। ব্রেইন টিউমারের ক্ষেত্রে অন্যান্য টিউমারের মতোই চিকিৎসা করতে হয়। যেমন ব্রেইন টিউমারের জন্য মস্তিষ্কে যে চাপ সৃষ্টি হয় তা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে রেডিও বা কেমো থেরাপি দিতে হতে পারে। গুরুতর পর্যায়ে অপারেশন করা লাগতে পারে। তবে ব্রেইন টিউমার অপারেশন পুরোপুরি সফল হয় না। টিউমারটিকে ডিবাল্কিং বা ছোট করে ফেলা যায়। স্ট্রোক হলে কয়েলিং বা থ্রম্বোলাইসিস করা হয়।

করোনা মহামারির এ সময়ে এখন কোনো রোগীর রেড ফ্লাগ সাইন নিয়ে হাসপাতালে প্রথমে করোনা টেস্ট না করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করা হয়। কিন্তু অপারেশনের আগের চিকিৎসক ও নার্সের সুরক্ষার খাতিরে টেস্ট করিয়ে নেওয়া হয়।

কখনো কখনো সামান্য মাথাব্যাথা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে

আলোচনায় আরও জানা গেল, বাংলাদেশেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালেই দক্ষ চিকিৎসক দ্বারা সব ধরনের নিউরো রোগের উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতালে আছে ১০০ শয্যার বিশেষায়িত স্ট্রোক ইউনিট। এখানে স্বল্প খরচে মস্তিষ্কের নানা সমস্যার জটিল অপারেশন ও ইন্টারভেনশন করা হয়।

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ডা. আবু নাইম দর্শকদের মাথাব্যথাসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।