মানসিক রোগে ভুগছেন ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন আছেন, এমন রোগীও কখনো কখনো অতিরিক্ত উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ আচরণ করতে পারেন। এমন হতে পারে যে তিনি কিছুতেই ওষুধ খেতে চাইছেন না, ওষুধ ছুড়ে ফেলছেন বা চিকিৎসায় অসহযোগিতা করছেন। পরিবারের লোকজনও ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন কিংবা তাঁর সঙ্গে আর পেরে উঠছেন না।
সাধারণত গুরুতর মানসিক রোগে (যেমন: সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার) আক্রান্ত ও মাদকাসক্ত রোগীরা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। চিৎকার-চেঁচামেচি, জিনিসপত্র আছাড় মেরে ভেঙে ফেলা, আশপাশের মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের শারীরিকভাবে আঘাত করার ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। চিকিৎসাধীন রোগীরা পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করলে তাঁদের মধ্যে উত্তেজিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন? কীভাবে তাঁকে শান্ত করবেন?
আপাতদৃষ্টে রোগীকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে বা উন্নতি ঘটেছে মনে হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করে দিলে বা অনিয়মিত খাওয়ালে রোগী আকস্মিকভাবে উত্তেজিত আচরণ করতে পারেন।
রোগ শুরুর দিকে শনাক্ত হলে ও সঠিকভাবে চিকিৎসা পেলে এতটা খারাপ হয় না। সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগীরা নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে সচেতন হতে বা ওয়াকিবহাল হতে অক্ষম। তাই তাঁদের চিকিৎসায় স্বজনদের ভূমিকা অনেক। প্রাথমিক অবস্থাতেই এসব রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিন ও ফলোআপে থাকুন। একজন উত্তেজিত মানসিক রোগীকে চিকিৎসা করার সময় মূল লক্ষ থাকে রোগী যেন নিজের অথবা আশপাশের মানুষের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ান। এ জন্য ধাপে ধাপে রোগীর চিকিৎসা এগিয়ে নিতে হয়।
প্রাথমিক ধাপে রোগীর সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলে তাঁকে আশ্বস্ত করে তাঁর উত্তেজনা প্রশমন করার চেষ্টা করা হয়। তাতে কাজ না হলে রোগীকে মুখে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। রোগী যদি এতটাই উত্তেজিত থাকেন যে ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না বা ওষুধ খাওয়ানোর পরও উত্তেজনা প্রশমিত হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে রোগীর মাংসপেশিতে অথবা শেষ ধাপে শিরায় ইনজেকশন দেওয়া হয়।
চিকিৎসার সময় রোগীর শরীরের তাপমাত্রা, শিরার গতি, রক্তচাপ ও নিশ্বাসের গতি নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
উত্তেজিত মানসিক রোগীদের সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া উচিত। ওষুধের মাধ্যমে রোগীর উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে গেলে তিনি সাধারণ ওয়ার্ড বা কেবিনে থাকতে পারেন। তবে রোগীর হাতের কাছে কোনো ধারালো বা ভারী বস্তু রাখা যাবে না এবং রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়ার পরও অনেক রোগীর উত্তেজনা প্রশমিত হতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে। এ সময় রোগী যেন নিজেকে অথবা আশপাশের
মানুষকে (আত্মীয়, অন্য রোগী, ডাক্তার, ওয়ার্ড বয়, নার্স) আঘাত করতে না পারেন, সে জন্য আবন্ধ রাখার (সেক্লুশন অ্যান্ড রিস্ট্রেইন্ট) প্রয়োজন হতে পারে।
সেক্লুশন বা রোগীকে একা রাখার ক্ষেত্রে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালে এমন কক্ষ থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশেষায়িত কক্ষের ভেতরে উত্তেজিত রোগী যেন দেয়ালে আঘাত করে নিজেকে আহত করতে না পারেন, সে জন্য সেক্লুশন কক্ষের দেয়াল নরম ফোম দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। রিস্ট্রেইন্ট বা রোগীকে বেঁধে রাখা হয়—সর্বোচ্চ মাত্রায় (ডোজ) ওষুধ দেওয়ার পরও রোগীর উত্তেজনা প্রশমিত না হলে রোগীকে সাময়িকভাবে বেঁধে রাখতে হয়। যাতে তিনি নিজেকে বা অন্য কাউকে আঘাত করতে না পারেন। এ ক্ষেত্রে রোগী যেন ব্যথা না পান সে জন্য রিস্ট্রেইন্ট জ্যাকেট বা রিস্ট্রেইন্ট বেল্ট ব্যবহার করা হয়, যা তুলা দিয়ে বানানো।
উত্তেজিত রোগীর চিকিৎসার নামে বাড়িতে বা হাসপাতালে কোথাও তাঁকে মারধর, শাস্তিমূলকভাবে বেঁধে রাখা, শাস্তি দেওয়া বা রূঢ় আচরণ করা যাবে না।
মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য শারীরিক রোগের (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) চিকিৎসা যেন অবহেলিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অস্বাভাবিক আচরণের অন্য কোনো কারণ, যেমন কোনো মেটাবলিক সমস্যা, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা, স্ট্রোক ইত্যাদি আছে কি-না, তা–ও দেখে নেওয়া উচিত।