নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু একজন নতুন মা সন্তানকে দুধ পান করাতে আন্তরিক হলেও নানা সমস্যায় পড়েন। কখনো মনে হয় শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না, শিশুর খিদে মিটছে না। কখনো মনে হয় ঠিকমতো খাওয়াতে পারছেন না। কর্মজীবী মা হলে তো কথাই নেই।
শিশুর দুধপানের এই সমস্যা নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরাও নানা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। নানাজনের নানা মত, নানা উপদেশ প্রসূতি মাকে আরও বেশি চাপে ফেলে দেয়। হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন অনেক মা।
দুধ পান করছে না নবজাতক
জন্মের পরপর মায়ের যে দুধ উৎপন্ন হয়, তা দেখতে অনেক সময় দুধের মতো নয়। পরিমাণেও তা অল্প। এটা শালদুধ। নবজাতকের জন্য এটি বিশেষভাবে জরুরি ও উপকারী। তাই শালদুধ ফেলে দেবেন না। বারবার শিশুকে দিন। প্রচুর পরিমাণে পানি আর পুষ্টিকর খাবার খান। সন্তান জন্মের পরপর ব্যথা, অস্বস্তি, অস্ত্রোপচারের ফলে নড়াচড়ায় কষ্ট প্রভৃতি কারণে মা এমনিতেই অশান্তির মধ্যে থাকেন। তাই মাকে সবাই মিলে মানসিক শক্তি দিন, উৎসাহ দিন। ধৈর্য হারাবেন না। নতুন মাকে সবাই মিলে সাহায্য করলে তিনি সফলভাবে দুগ্ধপান শুরু করাতে পারবেন। মনে রাখবেন, দুধ বেশি আসার স্টিমুলাস বা উদ্দীপক হলো শিশুর সাকিং বা দুধ টানা। শিশু যত বেশি দুধ টানবে, তত বেশি মায়ের শরীরে হরমোনগুলো কাজ করবে আর দুধ বেশি উৎপন্ন হবে। এমনকি শিশুর স্পর্শও মায়ের বুকে দুধ উৎপাদন করতে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
ও তো সারা দিন ঘুমায়
একজন নবজাতক দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুরুর দিকে প্রায় ২২ ঘণ্টাই ঘুমাতে পারে। এটা স্বাভাবিক। আর ঘুমের মধ্যে সাধারণত শিশুরা মায়ের দুধ খায় না। তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। খিদে পেলে শিশুরা নিজে নিজেই জাগে, হাত পা ছোড়ে, জিব নাড়তে শুরু করে, মুখে আঙুল দেয় বা এদিক-ওদিক খোঁজে। এগুলোই তার খাবার চাহিদার লক্ষণ। তাই শিশুর দিকে লক্ষ রাখুন। জাগলেই তাকে দুধ দিন। পেট ভরে তৃপ্ত হলে সে এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু যথাসময়ে না দেওয়া হলে এমন কান্না জুড়ে দেবে যে খাওয়ানো কঠিন হবে। শিশুরা ছোট হলেও তাদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে হবে। ঘুম থেকে তুলে জোর করে খাওয়াতে যাবেন না।
শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না
৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মোটামুটি মাতৃদুগ্ধ পান বা ব্রেস্ট ফিডিংয়ের অভ্যাস রপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু দেখা যায়, শিশু বারবার টানছে কিন্তু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। এর কারণ হলো সঠিক অ্যাটাচমেন্টের অভাব। নতুন মাকে সঠিক পজিশনিং আর অ্যাটাচমেন্ট শিখে নিতে হবে হাসপাতাল থেকেই। প্রথম কথা, শিশু ও মা আরামদায়ক অবস্থানে বসবেন। মা শিশুকে এমনভাবে কোলে নেবেন যেন শিশুর মাথা থাকে মায়ের এক হাতের কনুইয়ের ওপর। মা অন্য বাহু দিয়ে শিশুর পুরো শরীরকে জড়িয়ে নিজের শরীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে ধরবেন। শিশুর থুতনি মায়ের স্তন স্পর্শ করবে। হাত দিয়ে মা নিজের স্তন এমনভাবে ধরবেন যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি নিপলের ওপরে থাকে আর বাকি চার আঙুল নিপলের নিচে থাকে। এবার এভাবে আঙুল দিয়ে ধরে নিপল ও চারপাশের গোটা কালো অংশ শিশুর মুখে পুরে দিলে শিশু যথেষ্ট দুধ পাবে। এক স্তন পুরোটা খালি হলে অন্য স্তনে দেবেন।
মায়ের দুধে অনীহা
অনেক শিশু মায়ের দুধ দিলে মুখ ফিরিয়ে নেয় কিন্তু বোতলে ভরে দিলে খেতে চায়। এটা কাদের হয়? যদি শুরুতে মা অসুস্থ থাকায় বা যথেষ্ট দুধ না পাওয়ায় শিশুকে দু-এক দিন বোতলে বা ফিডারে কৌটার দুধ দিয়ে থাকেন। ফিডারে দুধপান মায়ের দুধ পানের চেয়ে সহজ। তাই শিশুরা সহজ কাজটিই বেছে নিতে চায়। তাই ভুলেও এ কাজ করবেন না। প্রথম দিকে সব মায়েরই সমস্যা হতে পারে। ধৈর্য ধরে এর মোকাবিলা করতে হবে। চট করে ফিডার দেবেন না।
বদহজম হচ্ছে
প্রতিবার দুধ পানের পর অল্প অল্প করে শিশুর নরম পায়খানা হলে মায়েরা অস্থির হয়ে পড়েন। মায়ের দুধে ল্যাকটোজ বেশি, তাই এমন হতে পারে। এমনকি দিনে ২০-২৪ বারও অল্প করে নরম পায়খানা হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ জন্য দুধ বন্ধ করতে হবে না। অনেক মা এ সময় নিজের নানা ধরনের খাবার বন্ধ করে দেন এই ভয়ে যে মায়ের খাবার থেকে বুঝি এই বদহজম হচ্ছে। শাকসবজি, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস খেতে নিষেধ করেন অনেকে। এর কোনটিই ঠিক নয়। মা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি সব রকম খাবারই খাবেন।
তোলা দুধের ভুল ধারণা
বেশির ভাগ মায়েরই ধারণা, শিশু শুধু মায়ের দুধ খাচ্ছে আর যথেষ্ট মোটাতাজা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অন্য শিশুদের চেয়ে খারাপ। তোলা বা কৌটার দুধ দিলে বোধ হয় শিশু স্বাস্থ্যবান হতো। খুবই ভুল ধারণা। শিশু যদি সারা দিনে অন্তত ছয়বার প্রস্রাব করে, হাসিখুশি ও চঞ্চল থাকে, যদি প্রতি মাসে আধা কেজি করে ওজন বাড়ে, তবে বুঝবেন তার স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
কর্মজীবী মায়ের জন্য
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কর্মজীবী মায়ের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া অধিকার। কিন্তু তার পরও নানা কারণে মায়েদের কাজে বাইরে যেতে হয়, কেউ আগে বেশি ছুটি নিয়ে ফেললে পরে সমস্যায় পড়েন। কাজে যোগদানের কারণে অনেক শিশু মাতৃদুগ্ধ পান থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। মা ব্রেস্ট পাম্প করে বা হাত দিয়ে চেপে দুধ বের করে শিশুর জন্য রেখে যেতে পারেন। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এটি ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত আর রেফ্রিজারেটরে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। ঠান্ডা দুধ বের করে বাটিটা একটি গরম পানি ভরা পাত্রে কিছুক্ষণ চুবিয়ে উষ্ণ করে নিতে হবে। ফিডারে নয়, এটি চামচ ব্যবহার করে খাওয়াতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় মায়ের কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ারের সিস্টেম গড়ে তোলা সম্ভব হলে। এ বিষয়েও সবার এগিয়ে আসা উচিত।