বাত একটি সিস্টেমিক বা প্রগ্রেসিভ ডিজিজম অর্থাৎ যা কিনা পুরো শরীরে প্রভাব ফেলে। এর ফলে যেকেউ শয্যাশায়ী ও কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়াতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা এবং সচেতনতা।
বাতের নানা উপসর্গ, কারণ ও প্রতিকার নিয়ে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ইজোরাল মাপস স্বাস্থ্য আলাপন’। অনুষ্ঠানটির দ্বাদশ পর্বে আলোচনা করা হয় বাতের ব্যথা ও এর আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ে। এভারকেয়ার হসপিটালস ঢাকার প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরীর সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন মেডিসিন ও বাতব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ।
অনুষ্ঠানটি ২৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ কথা বলেন বাতব্যথার নানা ধরন ও কিছু সাধারণ ভুল ধারণা নিয়ে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেকের মধ্যেই একটি ভুল ধারণা রয়েছে, তা হচ্ছে বাতজ্বর ও বাতের ব্যথাকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। কারণ হচ্ছে বাতজ্বরে গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়। বাতের ব্যথায়ও একই সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু দুটোর মধ্যে পার্থক্য হলো বাতজ্বরের ক্ষেত্রে জয়েন্টগুলো ফুলে যায়। শরীরের বড় জয়েন্টগুলো আক্রান্ত হয়। এই ব্যথা নড়াচড়া করে। অর্থাৎ একটি জয়েন্টে ব্যথা হলো সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাবে আরেকটি জয়েন্টে ব্যথা হচ্ছে। একে পলিআরথ্রাইটিস বলা হয়। এটি হলো বাতজ্বরের নির্দিষ্ট পয়েন্ট। বাতজ্বর সাধারণত ছোটদের, অর্থাৎ পাঁচ থেকে পনেরো বছরের বাচ্চাদের হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, গিরার ব্যথা হচ্ছে সাময়িক একটি সমস্যা। এই রোগে গিরা বা জয়েন্টে ব্যথা হলেও তা চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে। দীর্ঘমেয়াদি বাতব্যথার অনেক ধরনে রয়েছে। সঠিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন এই ধরন নির্ণয় করা। কারণ, একেক ধরনের বাতের চিকিৎসা একেক রকম।
এরপর মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ আলোচনা করেন এই রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার নিয়ে। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের বাতব্যথার প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা। এর পাশাপাশি ডিজিজ মডিফাইং অ্যান্টিরিউমেটিক ড্রাগ প্রয়োগ করা হয়। এগুলো ব্যথানাশক ওষুধ নয়। এগুলো রোগের ভেতর থেকে রোগ নিয়ন্ত্রণ করে। একপর্যায়ে আর ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হবে না। কখনো কখনো স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়ে, তবে তা স্বল্প সময়ের জন্য।
এগুলো মুখে খাওয়া বা ইনজেকশন ফর্মেও দেওয়া হয়। এরপরও যদি রোগীর অবস্থা ভালো না হয়, তবে রোগীকে আরও আধুনিক ওষুধ দেওয়া হয়। যার একটি হচ্ছে বায়োলজিক্যাল মেডিসিন। বাতব্যথার চিকিৎসায় আরও একটি জিনিস বুঝতে হবে, তা হচ্ছে এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ, অর্থাৎ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কথনো কখনো আমাদের বিরুদ্ধেই কাজ করে। তাই শুধু ওষুধ সেবনের পাশাপাশি কিছু লাইফস্টাইল মডিফেকেশনও প্রয়োজন। আবার কিছু কিছু বাত আছে, যেগুলো খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট মেনে চলতে হয়।
বাত একটি প্রোগ্রেসিভ রোগ, এটি চলতেই থাকে শরীরের ভেতর। তাই সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা প্রয়োজন। তা না হলে অন্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন চিকিৎসা না করলে এই রোগ প্রাথমিকভাবে শরীরের গিরা গুলোকে আক্রমণ করবে এবং নষ্ট করে ফেলবে। এরপর প্রচণ্ড ব্যথা হবে। এর পর্যায়ে গিয়ে গিরা বাঁকা হয়ে যাবে। রোগীর স্বাভাবিক নড়াচড়া ব্যাহত হবে। করান তিনি তার গিরাগুলো নড়াচড়া করাতে পারবেন না। এগুলো শুধু গিরার ক্ষতি করে না অন্য অঙ্গগুলোকেও আক্রান্ত করে। এতে লাং ফাইব্রোসিস হতে পারে, সেকেন্ডারি ভাসকুলার ডিজিজ হতে পারে, আমাদের আঙলগুলো কালো হয়ে যায় বা পচনও ধরতে পারে, আমাদের শরীরের চামড়ায় ক্ষত তৈরি করতে পারে। বাতের জন্য শরীরের চর্বির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ফলে হৃদ্রোগ দেখা দিতে পারে।
এটি শুধু গিঁট বা গিরার জন্যই ক্ষতিকর নয়। এটি শরীরের সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকেই আক্রান্ত করে। এটি মাল্টিসিস্টেম ডিজিজ। তাই বাতকে অবহেলা করা উচিত নয়। আর ওষুধ সেবনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। কারণ, অনেকেই আছে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছেমতো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করে থাকে। শুধু বাতের ব্যথায় নয়, সব ধরনের ব্যথায় এমনটি অনেকেই করে থাকে। এর ফলে কিডনি, লিভারে নানা রকম জটিলতা, খাদ্যনালিতে ঘা হওয়ার মতো গুরুতর সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। তাই যেকোনো রকমের ব্যথানাশক ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে খেতে হবে।
বাতের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় কিছু লাইফস্টাইল মডিফিকেশন প্রয়োজন। যেমন ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে। মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বাদ দিতে হবে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যেমন মাছ, মাংস (হাঁস, ভেড়া, কবুতর, খাসি ইত্যাদি), ডিম, শিমের বিচি, কলিজা ইত্যাদি খাওয়া যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।
যেসব রোগের কারণে গিঁটে ব্যথা হয়, সেসব রোগের যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে। কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। রিহ্যাবিলিটেশন ও ফিজিক্যাল থেরাপিও লাগতে পারে। বাতের ব্যথার চিকিৎসা সময়মতো করা সম্ভব হলে একজন মানুষ পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই সচেতনতার বিকল্প নেই।