প্রেমের অপরাধে মেয়েটিকে মেরে ঘরে আটকে রেখেছে

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

প্রশ্ন: একটা মেয়ের সঙ্গে আমার ৯ মাসের সম্পর্ক। আমার জীবনের চেয়েও তাকে বেশি ভালোবাসি। সে-ও আমাকে তার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর আমি একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করি। আমরা একজন আরেকজনকে আট বছর ধরে খুঁজেছি। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে তাকে পেলাম। সেখান থেকেই আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে শুরু হয়। মেয়েটির সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্কও হয়। আমি তাকে আমার ধর্মীয় মতে সিঁদুর পরাই। মেয়েটি আমাকে নিশ্চিত করে যে সে কখনো কোনো অবস্থায় আমাকে ছেড়ে যাবে না। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সে তার পরিবারকে আমার কথা জানিয়েছে। তারা আমাকে মেনে নেবে না বলেছে। সে-ও পরিবারকে জানিয়েছে, আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সে বিয়ে করতে পারবে না। কিছুদিন পর ওর মামা আমাকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। আমি কিছু বলিনি, শুধু শুনছি। তার মা-ও আমাকে গালমন্দ করে বলেন, ‘তুই আমার মেয়েকে ডিস্টার্ব করছিস কেন?’ আমি জানিয়েছি, আপনার মেয়েকে ডিস্টার্ব করলে আমার নামে মামলা করেন। মেয়েটির মা আমার সঙ্গে কথা বলছেন, ওদিকে তার মামা ও বাবা মিলে মেয়েকে মারছে। তার চিৎকার আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ তার এক ছোট বোন আমাকে জানিয়েছে, পরের তিন দিন মেয়েটি কিছু খায়নি। মারের কিছু ছবিও আমাকে পাঠিয়েছিল। দেখে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। এখন মেয়েকে আটকে রেখেছে। আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। সে বাসায় বলেছে, তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিলে বিয়ের পরদিনই আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারে। এখন আমার প্রশ্ন, আমাদের স্বপ্ন, ক্যারিয়ারের পাশাপাশি দুটি মানুষের জীবন শেষ করে দিতে যাচ্ছেন তার মা-বাবা। এখন আমরা কী করতে পারি। আমার অনুরোধ, আমি এখন কী করব বলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিলেট

উত্তর: তোমাদের খুব অল্প দিনের পরিচয়। এর মধ্যেই পরিবারের কথা বা তাদের মূল্যবোধের বিষয়গুলো একেবারে না চিন্তা করে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে! তুমি লিখেছ, তোমরা একে অপরকে আট বছর ধরে খুঁজছ—ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট হয়নি। তোমাদের আগে কোথাও দেখা হয়েছিল, নাকি মনে মনে পরস্পরকে খুঁজতে? মেয়েটির বয়স তো বেশ কম মনে হচ্ছে, এমনকি হতে পারে যে সে পুরোপুরি আবেগের বশবর্তী হয়ে স্বল্প দিনের পরিচিত একটি মানুষকে নিজের মন ও শরীর দুটোই সমর্পণ করে দিয়েছে। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা মেয়েটির ওপর অমানুষিক নির্যাতন করার ফলে সে যে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। তাঁরা যদি এতটা কঠোর মনোভাব না দেখিয়ে বরং মেয়েটির মনটা একটু বুঝতে চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো সবাই মিলে সময় নিয়ে এই পর্যায়ে করণীয় কী, তা ঠিক করতে পারতেন। মেয়েটির মামা ও মা যে তোমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করলেন, সেটির মাধ্যমে তাঁদের সীমারেখাটি লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রতি উত্তরে তুমিও কিছুটা উদ্ধত আচরণ করে ফেলেছ। এই ধরনের আচরণের ফলাফল কখনো শুভ হয় না। কারণ, অন্য পরিবারের একজনের সন্তানকে শাসন করার অধিকার আমরা রাখি না এবং এতে কোনো কাজও হয় না। তাঁরা যত বিরক্ত হন বা কষ্ট পান না কেন, দিন শেষে কিন্তু নিজের সন্তানটিকে কাছে ডেকে নিয়ে তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারতেন। আদর, ভালোবাসা দিয়ে তার মনটিকে জয় করার চেষ্টা করতে পারতেন। তাঁদের রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ প্রত্যেক মানুষকে মানসিক, শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে মেয়েটি যে বলছে, সে তোমাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, এই মনোভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ, সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে জীবন দান করেছেন, সেটিকে যত্ন করা এবং নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাটি অত্যন্ত জরুরি। মনে হচ্ছে, মেয়েটি শৈশব থেকে তার পরিবারের কাছে নিঃশর্ত ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাকে হয়তো স্নেহ করেছেন কিন্তু সেভাবে (সে যেমনই হোক না কেন) তাকে শ্রদ্ধাবোধ বা বিশ্বাস অনুভব করতে সহায়তা করেননি। নিঃশর্ত ভালোবাসায় চারপাশের মানুষদের প্রতি বিশেষ করে কাছের মানুষদের প্রতি তার অনেক মায়া-মমতাও তৈরি হয়। এক কথায় বলা যায়, আমাদের ভেতরে যখন কোনো শূন্যতা বিরাজ করে, তখন আমরা মনের শান্তির জন্য পরিবারের বাইরের মানুষদের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। মেয়েটির যে ছোট বোনটি তোমাকে ওর খবরগুলো জানাচ্ছে বা ছবি পাঠাচ্ছে, সেগুলো তোমাকে আরও বেশি অসহায় বোধ করাচ্ছে। কারণ, এ অবস্থায় তোমার তো কিছু করার নেই। তুমি তো তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে না। তুমি বরং বোনটিকে বলো যে মেয়েটি যেন কোনো অবস্থাতেই ধৈর্য হারিয়ে না ফেলে এবং নিজের জীবনকে বিপন্ন করে না তোলে। বড় বোনকে বোঝাতে বলো যে সে যেন খাবার ও পানি বর্জন না করে এবং সেই সঙ্গে মনের যত্নআত্তি করে। বেশি জেদ না করে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বলো এই মুহূর্তে কী করলে বাবা-মা তাকে এতটা নির্যাতন করবেন না। একই সঙ্গে তুমিও এই মানসিক অবস্থার ভেতর থেকেও যতটা সম্ভব নিজের যত্ন নাও।

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা

প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।

(খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA