পর্ব ১৩

নাক ডাকা ও নিদ্রাহীনতা

আমাদের দেশের মানুষের কাছে নাক ডাকা একটি সাধারণ বিষয়। এটি যে একধরনের শারীরিক সমস্যা, এ বিষয় অনেকেই জানেন না বা জানলেও বিষয়টি নিয়ে সচেতন নয়।

নাক ডাকা ও এর নানা উপসর্গ, কারণ ও প্রতিকার নিয়ে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ইজোরাল মাপস স্বাস্থ্য আলাপন’। অনুষ্ঠানটির ত্রয়োদশ পর্বে আলোচনা করা হয় বাত, নাক ডাকা ও নিদ্রাহীনতা বিষয়ে। ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ইমপালস হাসপাতালের নাক, কান ও গলা সার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জহির আল আমিন।
অনুষ্ঠানটি ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ইমপালস হাসপাতালের নাক, কান ও গলা সার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জহির আল আমিন

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডা. জহির আল আমিন আলোচনা করেন নাক ডাকা কী এবং কেন মানুষ নাক ডাকে, এ বিষয়ে। তিনি বলেন, নাক ডাকা একটি শারীরিক সমস্যা। আমাদের দেশে নাক ডাকা নিয়ে হাজারো রকমের ভুল ধারণা রয়েছে। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে এর সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। আর যেহেতু নারীদের তুলনায় পুরুষেরা বেশি নাক ডাকে, তাই এটি নিয়ে চর্চা কম আমাদের সমাজে। এটি একটি সামাজিক সমস্যাও, কারণ একজনের নাক ডাকার জন্য অন্যজনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতাও প্রয়োজন।

ডা. জহির আল আমিন বলেন, নাক আমরা কেন ডাকি। দেখবেন, একটি বাঁশের মধ্য দিয়ে যখন বাতাস প্রবাহিত হয়, তখন শব্দ হয় বা একটি বেলুন ফুলিয়ে ছেড়ে দিলে শব্দ হয়। কারণ, এর ফুটোটা চিকন। নাক ডাকার সাধারণ বিষয়টিও এটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি শ্বাসের রাস্তায় বাতাস ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হয়ে থাকে। এই বাধা নাসারন্ধ্র থেকে ফুসফুস পর্যন্ত যেকোনো স্থানে হতে পারে। সাধারণত নাক, তালু বা মুখগহ্বর হলো নাক ডাকার উৎপত্তিস্থল। এসব জায়গায় কোনো ধরনের রোগ বা প্রদাহের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে নাক ডাকার সৃষ্টি হয়। যারা অনেক মোটা, তাদের ক্ষেত্রে গলায় অতিরিক্ত মেদ জমা নাক ডাকার প্রধান কারণ হতে পারে। নাক ডাকার দ্বিতীয় কারণ হলো নাকের নানা ধরনের সমস্যা। সাধারণত নাকের হাড় বাঁকা, নাকের অ্যালার্জি, নাকের ভেতরের মাংস বেড়ে যাওয়া, নাকের পলিপ—এগুলোই নাকের সমস্যার প্রধান কারণ।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্বাসনালির টিউমার অথবা জিহ্বার পশ্চাৎ ভাগের টিউমার বা টনসিলের টিউমার নাক ডাকার কারণ হতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে। সাধারণত পুরুষেরা বেশি নাক ডাকে। তবে চল্লিশোর্ধ্ব নারীরাও নাক ডাকেন। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরাও নাক ডাকে। শিশুদের নাক ডাকার কারণ হলো এডেনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে অথবা ঘনঘন ইনফেকশনজনিত অথবা কোনো কারণে টনসিল বড় হয়ে গেলে অথবা উভয় ক্ষেত্রেই এটি হতে পারে।

আরও একটি বিষয় মনে রাখা উচিত, ঘুমের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে মৃত্যুও হতে পারে।

আসলে যারা নাক ডাকে, তারা নিজেরাই জানে না যে তারা নাক ডাকছে। এ অবস্থায় তার সহধর্মিণী কিংবা তার সঙ্গে যে ঘুমায়, তার ঘুমের বারোটা। বিরক্তির একশেষ। অনেক সময় এটি হাসিরও খোরাক। অনেকে আবার ভাবে নাক ডাকা মানেই ভীষণ গভীর ও নিশ্চিত ঘুম। এটি খুবই ভুল ধারণা। আসলে এটি দৈহিক সমস্যার সতর্কসংকেত। শ্বাসযন্ত্র ও আরও কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে মানুষ নাক ডাকে। অনেক সময় নাক ডাকা নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিরও আলামত।

আরও একটি বিষয় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। নাক ডাকা মানেই আপনার শরীর জানিয়ে দিচ্ছে, ঘুম একেবারেই ভালো হচ্ছে না। ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালিতে বাতাসের যাতায়াত বাধা পাচ্ছে। পরিণামে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। এ জন্য ভালো ঘুম হচ্ছ না, এমনকি সারা দিন অবসাদগ্রস্ত থাকছেন। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে মস্তিষ্ক কাজ কম করবে, ক্লান্ত লাগবে। তাই যারা নাক ডাকে, তারা শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে। একজন সুস্থ মানুষের ঘুমোতে আট থেকে বারো মিনিট সময় লাগে। সুতরাং যারা শোয়ার দু–চার মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে, বুঝতে হবে তাদের শারীরিক সমস্যা রয়েছে।

নাক ডাকা মানেই আপনার শরীর জানিয়ে দিচ্ছে, ঘুম একেবারেই ভালো হচ্ছে না। ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালিতে বাতাসের যাতায়াত বাধা পাচ্ছে। পরিণামে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে।

আরও একটি বিষয় মনে রাখা উচিত, ঘুমের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং নাকা ডাকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

এরপর অধ্যাপক ডা. জহির আল আমিন আলোচনা করেন এর প্রতিকার নিয়ে। তিনি বলেন, নাক ডাকার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে বুঝতে হবে, কখন আপনি চিকিৎসকের কাছে যাবেন। যখন কেউ সব সময় নাক ডাকে, সব পজিশনে নাক ডাকে, ঘুমের মধ্যে সারা রাত নাক ডাকে, নাক ডাকা অনেক উচ্চ মাত্রায় হবে না। এমন সব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটি প্রচলিত বিষয় হচ্ছে নিজে নিজে চিকিৎসা করা। এটি মোটেও উচিত নয়। কিছু কিছু সাধারণ অসুখে প্রাথমিক অবস্থায় নিজে নিজে চিকিৎসা শুরু করা গেলেও পরে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।