দাঁত ও মাড়ির সমস্যায় আপনার জিজ্ঞাসা ও উত্তর

দাঁত ও মাড়ির সমস্যায় পাঠকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল কলেজ, ঢাকার সহযোগী অধ্যাপক শিশু দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হুদা মান্নান। দাঁত ব্রাশ, মাড়ির সমস্যা ও দাঁতের যত্ন কীভাবে নেওয়া যেতে পারে, এসব বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল।

দেশের প্রতিটি খাতেই আমরা অসাধারণ উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি। ডেন্টিস্ট্রি কমিউনিটির একজন হিসেবে আপনার কি মনে হয় ওরাল হেলথ কেয়ার সেক্টরেও এমন পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে?

এর উত্তরে হুদা মান্নান বলেন, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। এটা বলতেই হবে যে আমাদের দেশ ইদানীং সব সেক্টরই বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর সুফলও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাচ্ছি। অন্যদিকে আপনি খেয়াল করে দেখবেন, বাংলাদেশে ওরাল হেলথ কেয়ারেও চোখে পড়ার মতোই পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে এ দেশের মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন সচেতনতা ছিলই না। তারা সাধারণত দাঁত পরিষ্কার করার জন্য নিমের কাঠি, ছাই ইত্যাদি ব্যবহার করত। নব্বইয়ের দশকে এ অবস্থার আসল পরিবর্তনটা শুরু হয়।

ছাই দিয়ে বা শুধু পানি দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করার অভ্যাসটা কিন্তু এখন আর নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষ সচেতন হয়ে বিশেষায়িত টুথপেস্ট ব্যবহার করতে শুরু করেছে, যা দাঁতের জন্য খুবই উপকারী। সরকার, প্রফেশনাল ডেন্টিস্ট ও দাঁতের যত্নে ব্যবহৃত প্রোডাক্ট ম্যানুফেকচারিং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই ধীরে ধীরে এ সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’

সাধারণ মানুষ কীভাবে তার দাঁতের যত্ন নিতে পারে? আর এ জন্য তাদের কী করা উচিত? এ প্রশ্নের উত্তরে হুদা মান্নান বলেন, ‘আমরা সব সময় বলে আসছি যে সঠিক নিয়ম মেনে দাঁতের যত্ন নিলে দাঁত সুন্দর ও মজবুত থাকবে দীর্ঘদিন। আমরা যদি সঠিক সময়ে দাঁতের যত্ন না নিই, তাহলে দাঁতে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেবে। যেমন দাঁতে ক্যাভিটি, মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁত শিরশির সমস্যা ইত্যাদি। আর তাই দাঁত থাকতেই আমাদের দাঁতের যত্ন নিতে হবে। দাঁতের যত্নে নিয়মিত সকালে নাশতার পর ও রাতে খাবারের পর দুবার সঠিকভাবে দুই মিনিট ধরে একটি ভালো মানের টুথপেস্ট, যেমন Sensitive Expert by Pepsodent দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। টুথব্রাশটিও কিন্তু ভালো মানের ও নরম হতে হবে। প্রতি তিন থেকে পাঁচ মাস পরপর ব্রাশ পরিবর্তন করতে হবে। শুধু দাঁত ব্রাশ করলেই হবে না, পাশাপাশি জিবও ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন অ্যাসিডিক খাবার, ধূমপানসহ পান, তামাক, জর্দা ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, যা দাঁতের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।’

শিশু দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ হুদা মান্নান আরও বলেন, দাঁত বা মুখের ভেতরে যেকোনো সমস্যা হলে অবহেলা না করে অতিসত্বর ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে মুখ ও দাঁতের চেকআপ করানো উচিত। আর এখন তো দাঁতের যত্নে রোগীদের সচেতনতা তৈরি করার জন্য Sensitive Expert by Pepsodent–এর বিভিন্ন ফ্রি ডেন্টাল ক্যাম্পেরও আয়োজন করা হয়। এসব ফ্রি ডেন্টাল ক্যাম্পের মাধ্যমেও কিন্তু রোগীরা চাইলে তাদের দাঁতের চেকআপ করাতে পারে।

আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে যে দাঁতে পোকা ধরে। আসলে ঘটনাটা কী? এর উত্তরে এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘আসলে খাওয়ার পর সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করা না হলে দাঁতে জমে থাকা খাবারে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। এর ফলে মুখে অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। ফলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়। প্রকৃতপক্ষে সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করা এবং দাঁতের প্রতি যত্নশীল না হওয়ার কারণে হওয়া ক্যাভিটির ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যায়। এ ছাড়া দাঁতের মাড়ি সরে যাওয়া, পেরিওডনটাইটিস, টারটার, দাঁত ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা যখন ঘটে, সাধারণ মানুষ তখন এটাকেই দাঁতে পোকা ধরেছে বলে মনে করে। আপনি আজকাল নিশ্চয়ই দাঁতের সেনসিটিভিটি নিয়েও বেশ আলোচনা শুনে থাকবেন। সবই আসলে দাঁতের রোগ।’

চিকিৎসকের কথার সূত্র ধরেই জানতে চাওয়া হয়, দাঁতের সেনসিটিভিটি বর্তমান সময়ের দাঁত–সম্পর্কিত সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কীভাবে বুঝব আমার দাঁতে সেনসিটিভিটি আছে? আর কীভাবেই এর থেকে সুস্থতা লাভ করা যায়? এর উত্তরে শিশু দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ হুদা মান্নান বলেন, ‘আপনি যদি খেয়াল করেন, দেখবেন আমাদের লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভ্যাস কিন্তু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমরা এখন প্রচুর ফাস্ট ফুড, কোল্ড ড্রিংকস ও নানা ধরনের অ্যাসিডিক খাবার খেয়ে থাকি। স্বাভাবিকভাবেই সঠিক উপায়ে দাঁতের যত্ন না নিলে ধীরে ধীরে দাঁতের এনামেল ক্ষয়ে যায়। এভাবে ক্ষয় হতে থাকলে একসময় ডেন্টিন বের হয়ে আসে। এই উন্মুক্ত ডেন্টিনের সংস্পর্শে ঠান্ডা বা গরম খাবার এলেই দাঁতে শিরশির অনুভূতি হয়। দাঁতের সেনসিটিভিটি বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ঠান্ডা বা গরম পানি খেলে যদি আপনার দাঁতে শিরশিরে অনুভূতি হয়। আবার টক বা মিষ্টি খাবার খেলেও দাঁতে অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে পারে। অবাক ব্যাপার হলো প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে একজন দাঁতের সেনসিটিভিটি সমস্যায় ভোগেন। অথচ এই বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষই জানেন না। আর দাঁতের সেনসিটিভিটিজনিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত বছরে অন্তত দুবার ডেন্টিস্টের কাছে যান, তাহলে এই রোগটি প্রাথমিক স্তরেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে। আর যদি দাঁতের সেনসিটিভিটিজনিত সমস্যায় ভোগেন, তাহলে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য আপনি অবশ্যই অ্যান্টি-সেনসিটিভিটি টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। এ ক্ষেত্রে আমি সাধারণত সবাইকে Sensitive Expert by Pepsodent ব্যবহার করতে বলি।’

তাহলে কী শুধু অ্যান্টি-সেনসিটিভিট টুথপেস্ট ব্যবহারে সচেতন হলেই হবে? নাকি এ ক্ষেত্রে টুথব্রাশেরও কোনো ভূমিকা রয়েছে? এর উত্তরে হুদা মান্নান বলেন, ‘দেখুন, একটা কথা সবাইকে বুঝতে হবে যে দাঁতের রোগ শুধু একটি কারণে হয় না। এর পেছনে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। এ ব্যাপারে আমাদের সবারই সচেতন হতে হবে।

আপনার টুথব্রাশই যদি স্বাস্থ্যসম্মত না হয়, তাহলে টুথপেস্ট নিয়ে সচেতন হয়েই কী লাভ! টুথব্রাশের ব্রিসল শক্ত হলে দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। আবার একই সঙ্গে ব্রিসল যদি অস্বাস্থ্যকর হয়, তাহলেও তা দাঁতের জন্য তা ক্ষতিকর। বেশির ভাগ টুথব্রাশে রিসাইকেলড প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। টুথব্রাশ কেনার আগে তাই অবশ্যই দুটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। টুথব্রাশটি ভার্জিন ম্যাটেরিয়ালে তৈরি ও নরম ব্রিসলযুক্ত কি না। এ ক্ষেত্রেও আমি পেপসোডেন্ট টুথব্রাশ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি বাংলাদেশের ডেন্টিস্ট্রি কমিউনিটিতে অন্যতম বৃহত্তম সংগঠন। সংগঠনটির একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে আপনি যদি ওরাল হেলথ বিষয়ে আপনাদের ভূমিকা নিয়ে একটু বলতেন। এর উত্তরে সহযোগী অধ্যাপক হুদা মান্নান বলেন, ‘সংক্ষেপে যদি বলি, বাংলাদেশের সবখানে ওরাল হেলথ কেয়ার সুবিধা পৌঁছে দিতে একটানা কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি। দাঁতের যত্নের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে আমাদের ডেন্টিস্টরা ছুটে বেড়াচ্ছেন পুরো দেশে। এ জন্য আমরা ও পেপসোডেন্ট একসঙ্গে একদম স্কুলের শিশুদের থেকে শুরু করে প্রবীণদের কাছে ছুটে যাচ্ছি ফ্রি ডেন্টাল ক্যাম্প, ডেন্টিস্ট উইদ আ হার্ট প্রোগ্রাম, সায়েন্টিফিক সেমিনারসহ নানা কার্যক্রম ও ক্যাম্পেইন নিয়ে। স্কুলগুলোতে ছুটে যাওয়ার আসল কারণটাই হলো ছোটবেলা থেকেই যেন দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে, সে জন্য সচেতনতা তৈরি। এই যে দেশের মানুষ এখন দাঁতের যত্ন নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছে, এর পেছনে আমি বলব বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।’

যাদের ইতিমধ্যেই দাঁতের ক্ষয় (শিরশির) শুরু হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আপনি কি পরামর্শ দিতে চান? এর উত্তরে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘কারও ইতিমধ্যেই দাঁতের ক্ষয় শুরু হয়ে গেলে দ্রুত ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হয়ে ডেন্টাল চেকআপ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক উপায়ে দাঁত ব্রাশ না করলে, জোরে জোরে শক্ত ব্রিসলযুক্ত টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করলে, অভ্যাসগত কারণ বা অ্যাসিডিক খাবার বেশি খেলে ইত্যাদি কারণে রোগীদের দাঁতের ক্ষয় হতে পারে। আমরা যদি দাঁতের গঠন চিন্তা করি, প্রথম এনামেল, এরপর ডেনটিন। তাহলে এখানে প্রথমে এনামেল ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ডেনটিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এই পর্যায়ে দাঁত ঠান্ডা বা গরম খাবারের সংস্পর্শে এলে দাঁতে শিরশির অনুভূতি হয়।

‘যদি মিনারেল ক্ষয় হতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং খুব ভালো মানের মিনারেলসমৃদ্ধ টুথপেস্ট যেমন Sensitive Expert by Pepsodent ব্যবহার করলে মিনারেলের পুনর্গঠন হতে পারে। আর যদি ডেনটিন ক্ষয় হয়ে যায়, অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। আর শক্ত খাবার কমিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পান–সুপারি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।’

দাঁতের ও মুখের রোগ যেন না হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধের জন্য কী করণীয়? প্রাথমিক পর্যায়ে দাঁতের রোগ প্রতিরোধের জন্য কয়েক দিন পরপর দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে? এর উত্তরে হুদা মান্নান বলেন, ‘প্রতিরোধের প্রথম কথা হলো সঠিক উপায়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। নরম টুথব্রাশ নিয়ে, গুণতগত মানের পেস্ট, যেমন Sensitive Expert by Pepsodent দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। এক থেকে দুই মিনিট ব্রাশ করতে হবে। সঠিক উপায়ে ব্রাশ করার বিষয়টি জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, দাঁতের ফাঁকের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। ডেন্টাল ফ্লস দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। জিব পরিষ্কার করতে হবে। মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। আর সুতা কাটা বা নখ দাঁত দিয়ে কাটার অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। দাঁত ও মুখের সমস্যা হোক বা না হোক, বছরে দুবার, অর্থাৎ ছয় মাস পরপর অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তাহলে শুরুর দিকে সমস্যা জেনে গেলে রোগী সেখান থেকে আর পরে বড় কোনো সমস্যায় ভুগবে না।’