ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ বেড়েছে। এডিস মশার কারণেই ছড়ায় ডেঙ্গু। তাই ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ রোধে সচেতন হতে হবে। এ জন্য কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।
স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ময়লা–দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দ নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী জায়গাগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। মশা মারার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও এডিস মশা কামড়াতে পারে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব হলে ঘরের দরজা ও জানালায় নেট লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলন্ট স্প্রে, লোশন, ক্রিম, কয়েল ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরাতে হবে।
এডিস মশা জমা হওয়া স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। তাই ঘরে সাজানো ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন থেকে পাঁচ দিন পরপর ফেলে দিতে হবে। এতে এডিস মশার লার্ভা মারা যায়। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরের অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বাড়ির ছাদে অনেকেই বাগান করে থাকেন। সেখানে টবে বা পাত্রে যেন কোনো ধরনের পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না জমে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরের বাইরে মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে—যেমন: ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের পরিত্যক্ত খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে।
সপ্তাহে অন্তত তিন দিন মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করতে হবে। বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোতেও যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল দিতে হবে।
এ ছাড়া আরও কতগুলো দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এগুলো হলো:
এডিস মশা সাধারণত সূর্যোদয়ের আধা ঘণ্টার মধ্যে ও সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা আগে কামড়াতে পছন্দ করে। তাই এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকুন।
বর্ষাকালে ঘুমানোর আগে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন। এটা ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা। এডিস মশা দিনের বেলাতেও কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমালেও মশারি ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে শুধু দিন নয়, রাতের বেলাও সারা শরীরে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা দরকার। মশা তাড়াতে অনেকে তেলও ব্যবহার করে থাকে।
বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের আনাচকানাচে মশার স্প্রে বা ওষুধ ছিটান। তাহলে এসব জায়গায় মশা বাড়বে না।
বাসার আশপাশে ময়লা পানি যাতে জমতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
জানালার পাশে তুলসীগাছ লাগান। এই গাছে এমন কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা মশা তাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মশা নিধনে নতুন বাহিনী হলো গাপ্পি মাছ। সব ধরনের আবহাওয়ায় গাপ্পি মাছ দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। পানির ওপরের অংশে ঘোরাফেরা করে। এ মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে বলে বিভিন্ন দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে গাপ্পির ব্যবহার রয়েছে। একটি গাপ্পি মাছ দিনে গড়ে ৫০টি লার্ভা ধ্বংস করতে পারে। প্রতিবেশী ভারতে এ মাছের সাহায্যে মশা ধ্বংস করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক উপায়ে মশা তাড়াতে কর্পূর ব্যবহারের বিকল্প নেই। দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর জ্বালিয়ে রুমের ভেতর রাখুন। ২০ মিনিট পর দেখবেন মশা একেবারেই চলে গেছে। মশার হাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় কর্পূর জ্বালিয়ে রাখুন।
গ্রিন লাইফ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এম এ আজহার বলেন, ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়—ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার ও হেমোরেজিক ফিভার। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মাথায়, চোখের পেছনে, হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। জ্বর হওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমি, রোগীর অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা, রুচি কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ, বুকে বা পেটে পানি আসা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
ডেঙ্গু জ্বর সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসক এম এ আজহার বলেন, জ্বরের চার থেকে পাঁচ দিন পর সিবিসি এবং প্লাটিলেট টেস্ট করতে হবে। এর আগে টেস্ট করলে রিপোর্টে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে। সাধারণত প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হলে ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু অ্যান্টিবডির পরীক্ষা পাঁচ থেকে ছয় দিন পর করা যেতে পারে। এটি রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করে। যেহেতু রোগের চিকিৎসায় এর কোনো ভূমিকা নেই, তাই এই পরীক্ষা না করলেও কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষা, যেমন: এসজিওটি, এসজিপিটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করাতে হতে পারে।
আবার চিকিৎসক যদি মনে করেন, রোগী ডিআইসি–জাতীয় জটিল কোনো সমস্যায় আক্রান্ত, সে ক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করাতে হতে পারে।
চিকিৎসক এম এ আজহার বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দিনে সর্বোচ্চ চারবার প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
জ্বর কমানোর জন্য বারবার শরীর মুছে দিতে হবে। জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার, যেমন: ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে। বমির কারণে যদি কোনো রোগী পানি পান করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যাসপিরিন বা অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না।
সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগীকেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে জরুরি ভিত্তিতে প্লাটিলেট দিতে হবে।
নাজিয়া হোসেন: প্রথম আলোর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাংবাদিক