বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। বাংলাদেশেও এটি মৃত্যুহারের জন্য দায়ী রোগগুলোর তালিকায় রয়েছে। তাই ক্যানসার যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধ করা যায়, সে জন্য এর উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তবে আশার কথা হলো প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়। এর মধ্যে কিছু রয়েছে, যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার কিছু রয়েছে, যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিবর্তন করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা; আসলে নিয়মমাফিক চলাফেরার মাধ্যমে ক্যানসার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই ক্যানসারকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ আলোচনা।
এসকেএফ অনকোলজি নিবেদিত ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’-এর ১৯তম পর্বে অতিথি হিসেবে যোগ দেন ডা. জাহান আফরোজা লাকী, এমবিবিএস, এমফিল (রেডিওথেরাপি), ক্যানসার রোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রেডিওথেরাপি বিভাগ, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এ অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয়: জরায়ু মুখের ক্যানসার।
অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম।
ডা. জাহান আফরোজা লাকী বলেন, মায়ের পেটে থাকাকালে আমরা যেখানে অবস্থান করি, তা হলো জরায়ু। আর এর মুখ থেকেই যে ক্যানসারের সৃষ্টি হয়, তা হলো জরায়ু মুখের ক্যানসার। আমরা মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হই। শরীরের এই সুশৃঙ্খল বিভাজন কোনোভাবে বিঘ্নিত হলে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন হয়। এই অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন যখন হয়, তখন শরীরে একটি পিণ্ড বা চাকার সৃষ্টি হয়। সেটি বিনাইন হতে পারে, আবার ম্যালিগন্যান্টও হতে পারে। বিনাইনটি সাধারণত ক্ষতি করে না, তবে ম্যালিগন্যান্টটি ক্ষতিকর হয়ে থাকে। আমরা তাই ম্যালিগন্যান্ট নিয়েই আলোচনা করব। জরায়ু মুখের কোষে যদি পিণ্ডের সৃষ্টি হয় তবে তাকে জরায়ু মুখের ক্যানসার বলে।
আমাদের দেশে এটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আগে এটি প্রথম অবস্থানে ছিল, বর্তমানে টিকা আবিষ্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে এর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার মানুষ জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত এবং প্রায় ৩ লাখ ১১ হাজার মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করেছে। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয় এবং এদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার রোগী মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ যতজন রোগী শনাক্ত হয়, তার প্রায় অর্ধেকই মৃত্যুবরণ করে। এটি হলো বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বে জরায়ুমুখের ক্যানসারের একটি চিত্র। তবে আশার কথা এই যে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে জরায়ুমুখের ক্যানসার সম্পূর্ণ রূপে ভালো হয়ে যায় এবং এটিই একমাত্র ক্যানসার, যার টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে।
জরায়ুমুখের ক্যানসারের লক্ষণগুলোর মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত মাসিক অন্যতম। এটি বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন, প্রতি মাসে মাসিক অতিরিক্ত হওয়া কিংবা ইন্টারমিটেন্ট অর্থাৎ দুটি মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তক্ষরণ হওয়া। আবার অনেকের সহবাসের পর রক্তক্ষরণ হয়। এ উপসর্গগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি দেখা দিলেই দ্রুত গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া সাদা কিংবা লালচে স্রাব নিঃসৃত হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঁজ বের হতে পারে।
ক্যানসার যদি ব্লাডার বা শরীরের অন্য কোনো স্থানে ছড়িয়ে যায়, তখন প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মলত্যাগেও যন্ত্রণা অনুভূত হতে পারে। কারও কারও কোমরের পেছন দিকে কিংবা তলপেটে ব্যথা হয়ে থাকে। আরও অ্যাডভান্সড স্টেজে চলে গেলে ক্যানসারটি কিডনিতেও ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের পায়ে পানি আসে কিংবা শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। চলাফেরায় কষ্ট হয়। অনেক সময় এটি ফুসফুস কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।
জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেমন: ১৬ বছরের আগে কোনো মেয়ের বিয়ে না দেওয়া, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল ৫ বছরের বেশি সময় ধরে সেবন না করা, বহুগামিতা রোধ ইত্যাদি। এ ছাড়া ধূমপান, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ কিংবা অপরিচ্ছন্নতার কারণেও জরায়ুমুখের ক্যানসার হয়ে থাকে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। তা ছাড়া সময়মতো টিকা নিতে হবে।
ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অনেকেই থাকেন, যাঁরা চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা গড়ে তোলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায়, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময় ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত কিংবা অ্যাডভান্সড স্টেজে বিভিন্ন জটিল উপসর্গ নিয়ে আসে। বর্তমানে আমাদের দেশেও ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। তাই উপসর্গ দেখামাত্রই দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।