জন্ডিসের কথা শুনলে অনেকে ভাবেন, এ আর এমন কী; হরহামেশাই হচ্ছে, আবার টোটকা বা মামুলি কবিরাজি চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে আমরা জন্ডিস হলে একটু চিন্তিতই হই বৈকি। জন্ডিস যে ধরনের বা যে কারণেই হোক, এটি সব সময়ই একটি গুরুতর উপসর্গ। জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং অন্য কোনো রোগের লক্ষণ। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে শুরু করে সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে এই জন্ডিস। তাই জন্ডিস হলে অবহেলা করতে নেই।
আগে জানা দরকার জন্ডিস বলতে আমরা কী বুঝি। মানুষের রক্তে অনেক উপাদানের মধ্যে বিলিরুবিন একটি। এই বিলিরুবিনের উৎপত্তি রক্তের লোহিত কণিকা থেকে। রক্তের লোহিত কণিকা যখন স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখনই লিভারে এই বিলিরুবিন তৈরি হয় এবং পরবর্তী সময়ে রক্তে প্রবাহিত হয়ে মল ও প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। এই বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে এটি জমা হতে থাকে শরীরের বিভিন্ন কোষকলায়। আর তখন কোষকলার স্বাভাবিক রং পরিবর্তন হয়ে হলুদাভ হয়ে যায়। ত্বক ও চোখের ঝিল্লি হলুদ রং ধারণ করলে তা দৃশ্যমান হয় এবং জন্ডিস হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়।
জন্ডিস অনেক কারণে হয়ে থাকে। প্রথমত, যদি রক্তের লোহিত কণিকা অতিমাত্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে বেশি মাত্রায় বিলিরুবিন তৈরি হয়। যেমন থ্যালাসেমিয়া নামের রক্তরোগ। দ্বিতীয়ত, বিলিরুবিন তৈরির কারখানা তথা লিভারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে জন্ডিস হবে। যেমন ভাইরাল হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, ক্যানসার। তৃতীয়ত, বিলিরুবিন যদি কোনো কারণে লিভার থেকে বের হতে না পারে, বাধাপ্রাপ্ত হলে জন্ডিস হয়। যেমন পিত্তনালির পাথর বা টিউমার।
কীভাবে বুঝবেন আপনার কোন ধরনের জন্ডিস হয়েছে? রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ বিবেচনা করে কারণ অনেকাংশে শনাক্ত করা যায়। অল্প বয়স, জন্ডিসের সঙ্গে রক্তশূন্যতা থাকলে বুঝতে হবে লোহিত কণিকার মাত্রাতিরিক্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকেই এর উৎপত্তি, যাকে মেডিকেলের পরিভাষায় হিমোলাইটিক জন্ডিস বলে। জ্বর, পেটের ডান দিকে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি বা বমি ভাব হওয়ার পর চোখ ও জিব হলুদ হয়ে গেলে সাধারণত তাকে লিভারের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস মনে করা হয়। জন্ডিসের মাত্রা যদি অনেক বাড়তে থাকে, আর সঙ্গে পেটব্যথা, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, শরীরে চুলকানি থাকে, তখন পিত্তনালি বন্ধ হয়ে গিয়ে অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এতে সার্জারি লাগে বলে এর আরেক নাম সার্জিক্যাল জন্ডিস।
আমাদের দেশে সব বয়সের মানুষের অ্যাকিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা ভাইরাসজনিত লিভারের প্রদাহ হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। করোনাভাইরাসের এই সময়ে ভাইরাস সবার কাছে একটি আতঙ্কের নাম। হেপাটাইটিস ভাইরাসের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। ইংরেজি অক্ষর দিয়ে এই ভাইরাসগুলোর নামকরণ করা হয়ে থাকে, যেমন এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস। আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ই ভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। এ এবং ই ভাইরাস খাদ্য বা পানিবাহিত রোগ, অর্থাৎ দূষিত খাবার বা খাওয়ার পানির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায় এবং সাধারণত কোনো দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ তৈরি করে না। তবে কখনো কখনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বি, সি এবং ডি ভাইরাস রক্তবাহিত, যা দূষিত রক্তের সংস্পর্শের কারণে হয়ে থাকে। এই ভাইরাসগুলোতে জটিলতাগুলো বেশি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ হতে পারে, যা থেকে সিরোসিস, ক্যানসারসহ নানা জটিল পরিণতির দিকে যেতে পারে।
জন্ডিস একটি মারাত্মক ব্যাধি। জন্ডিস হলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। রোগীর লক্ষণ শুনে এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিতভাবে এর কারণ নির্ণয় করা যায়। তারপর কারণ অনুযায়ী ব্যবস্থা। স্বল্পমেয়াদি ভাইরাল হেপাটাইটিসের চিকিৎসা নিয়ে আমাদের দেশে অপচিকিৎসা হয় অনেক। ঝাড়ানো, মালা পড়া, নানান রকমের কবিরাজি ওষুধ বা লতাপাতা খাওয়া আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয়। জন্ডিস চিকিৎসায় এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উপরন্তু এসব কবিরাজি লতাপাতা-শিকড় অনেক সময় লিভারের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং চিকিৎসা বিলম্বিত হওয়ারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই ভাইরাসগুলোর একটি ভালো দিক হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে ওঠেন। রোগীর পূর্ণ বিশ্রাম, স্বাভাবিক সুষম পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে উপসর্গ অনুযায়ী কদাচিৎ ওষুধ দেওয়া হয়। জন্ডিস রোগীর খাবার নিয়েও অনেক কুসংস্কার আছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। জন্ডিসের রোগীর বেশি বেশি গ্লুকোজ বা চিনির শরবত, আখের রস খেতে হবে, হলুদ খাওয়া নিষেধ, বারবার গোসল করা বা মাছ-মাংস খেলে ক্ষতি হবে—কোনোটাই সঠিক নয়। সাধারণ সব খাবার তিনি খেতে পারবেন, তবে অতিরিক্ত তেল-চর্বি এড়িয়ে চলাই ভালো। খাবার সহজপাচ্য, স্বাস্থ্যকর ও বিশুদ্ধ হতে হবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভালো না হলে বা কোনো রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে বিলম্ব না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এই অস্বাভাবিকতা হতে পারে চেতনা কমে যাওয়া (এনকেফালোপ্যাথি), রক্তবমি বা কালো পায়খানা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদি।
অন্যান্য অনেক রোগের মতো ভাইরাস হেপাটাইটিস প্রতিরোধযোগ্য। কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, যেমন ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি গ্রহণ, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ না করা বা অন্যের ব্যবহৃত ব্লেড, সিরিঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহার না করাই হলো প্রতিরোধ করার অন্যতম উপায়। এ এবং বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী টিকা আছে, যা উপদেশানুযায়ী সবারই নেওয়া উচিত। বি ভাইরাসের টিকা সরকারি টিকা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।