পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমার বয়স ২৭ বছর। এক ছেলের সঙ্গে আমার পাঁচ বছর সম্পর্ক ছিল। আমাদের শারীরিক সম্পর্কও হয়। তার কথা বাড়িতে জানানোর পর আমাদের পরিবার রাজি হচ্ছিল না। তাই আমি তাকে বলি যে আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না। এরপর থেকে ছেলেটা আমার ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। সে বলেছে, আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে করতে দেবে না, আমাদের বাড়িতেও ভয় দেখাচ্ছে। সে আমার আত্মীয়স্বজনের কাছে আমার আর তার ছবি পাঠাচ্ছে আর সবাইকে আমার নামে আজেবাজে কথা বলছে।
আমার বিয়ের কোনো প্রস্তাব এলে তা ভেঙে দিচ্ছে। তাকে মামলা করার ভয় দেখালে বলে, কেউ নাকি তার কিচ্ছু করতে পারবে না। মামলা করলে সে জেল থেকে বের হয়ে আবার আমার ক্ষতি করবে। ছবি ‘পাবলিক’ করে সে নিজেও আত্মহত্যা করবে, আর সবার কাছে আমার নাম বলে যাবে, যাতে আমি বিপদে পড়ি। তার এসব দেখে আমাদের বাড়িতে ভয় পেয়ে তার সঙ্গেই বিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না। আমার কাছে মনে হয়, তার এসব কিছু মেনে নিলে পরে সে আরও খারাপ কিছু করার সাহস পেয়ে যাবে। এক বছর ধরে আমার তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কী করা উচিত?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: আপনার সাবেক প্রেমিক আপনার সম্পর্কে আত্মীয়স্বজনের কাছে কুৎসা রটাচ্ছে, ছবি পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্গে আপনাকে হুমকি দিচ্ছে এবং ব্ল্যাকমেল করছে। প্রথমত, যেহেতু সে আপনাকে নিয়ে আপনার আত্মীয়স্বজনের কাছে কুৎসা রটাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ এনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করা যায়।
ফৌজদারি আদালতে মানহানির মামলা করার ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। সে অভিযোগ শুনে আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারেন। মানহানির মামলায় সরাসরি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয় না। সমন দেওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি আদালতে হাজির না হন, সে ক্ষেত্রে বিচারক অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা এমন হতে পারে জেনেও উদ্দেশ্যমূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে ধরা হবে। দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি বর্ণনায় বলা হয়েছে, এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ড হতে পারে।
তা ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮–এর ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক বা মিথ্যা জেনেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে এর জন্য তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ এ ধরনের অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সে যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আপনাকে হুমকি দেয় ও ভীতি প্রদর্শন করে, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, ছেলেটি আপনাকে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য বা তাকে বিয়ে করার জন্য আপনার ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। বিয়ে না করলে সে ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে, কাজেই তা দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারা অনুযায়ী প্রতারণার সংজ্ঞায় পড়বে। আইনগত সংজ্ঞা অনুযায়ী কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তিকে এমন কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত করে, যার ফলে ওই ব্যক্তির শরীর, মন বা সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেটি প্রতারণা হবে। দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করে তার কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করে, সেটা ওই ব্যক্তির সম্মতি সাপেক্ষে হলেও প্রতারণা হবে।
যেহেতু সে আপনাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে, আপনি অবশ্যই থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করবেন। এই সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে পুলিশ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবে। দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার ক্ষমতাবলে সরাসরি আদালতেও অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে জিডি করলে পুলিশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে নন-এফআইআর প্রসিকিউশন দাখিল করতে পারে। জিডির পর পুলিশ যদি ঘটনার সত্যতা পায়, তাহলে হুমকিদাতার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর জন্য দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে। ৫০৬ ধারার অধীনে অপরাধমূলক হুমকির জন্য শাস্তি, দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারেন।
পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।
ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com
(সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)
ডাক ঠিকানা
প্র অধুনা
প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন
২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)
ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA