কোমল পেশির বাত ব্যথা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মিসেস হাসান, গৃহিণী, ৪৫ বছর বয়স। খুব ভালো রাঁধেন, রাঁধতে ও আপ্যায়ন করতে ভালোবাসেন। স্বামী–সন্তানদের যেমন প্রতিদিন মজার খাবার রেঁধে খাওয়ান, ঠিক তেমনই প্রতি সপ্তাহেই অতিথি আপ্যায়নে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। ভালোই চলছিল। হঠাৎ মাসখানেক ধরে তিনি আর ভালোভাবে রান্নার কাজ করতে পারছেন না। রান্নার কাজ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ডান কনুইতে শুরু হয় প্রচণ্ড ব্যথা। বাধ্য হয়েই গৃহকর্মীর হাতে সব দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় তাঁকে।

ইমতিয়াজ ২৮, উদীয়মান খেলোয়াড়, টেনিসে দুই বছর পরপর লিগ শিরোপা পেয়েছেন। আগামী মাসে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন। কিন্তু গত সাত দিন ধরে হঠাৎ ডান কনুইয়ের বাইরের দিকে খুব ব্যথা, টেনিস র‍্যাকেট ধরতে কষ্ট হয়, এমনকি কম্পিউটার মাউস ব্যবহার করতেও কষ্ট হচ্ছে।

পাঠক, এই দুটি ঘটনাই আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাতরোগের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাতরোগ বলা হলেও এটি মূলত কোমল পেশির বাত, যা কনুইয়ের জোড়ার (জয়েন্ট) ওপরের মাংশপেশিকে আক্রান্ত করে।

সাধারণভাবে এই রোগটি ‘টেনিস এলবো’ নামে পরিচিত। রিউমাটোলজির পরিভাষায় একে আমরা ‘ল্যাটারাল এপিকনডাইলিটিস’ বলি।

এই রোগের শিকার কারা
প্রায় সবাই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যাঁরা একটু হলেও কাজ করেন। ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য বিপাকজনিত রোগের রোগীরা সাধারণের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ এই রোগে ভোগেন। টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে যাঁরা বেকায়দায় র‍্যাকেট ধরেন ও ভুলভাবে শট নেন, তাঁদের পেশিতে ক্রমাগত বিরূপ চাপে ধীরে ধীরে পেশিমূল ও অস্থির আবরণের মধ্যে একটি মাইক্রো ট্রমা বা ক্ষত হয়, যা থেকে একটি মেয়াদি প্রদাহ সৃষ্টি হয়। আর সামষ্টিকভাবে এটাই টেনিস এলবো। টেনিস খেলোয়াড়দের ভেতর প্রথম রোগটি পাওয়া যায় বলে খেলার নামেই রোগের নামকরণ।

কারা আক্রান্ত হন
আগেই বলেছি ডায়াবেটিস ও অন্যান্য মেটাবলিক রোগের ব্যক্তিদের ভেতর এর প্রাদুর্ভাব বেশি। যাঁরা কনুই বেশি ব্যবহার করেন, গৃহিণী থেকে শুরু করে প্রোগ্রামার, পেশাদার বাবুর্চি—সবাই এর শিকার হন। রোগের লক্ষণ আমরা গল্প দুটির মধ্যেই উল্লেখ করেছি।

চিকিৎসা, প্রতিষেধক ও করণীয়
চিকিৎসার শুরুতেই আক্রান্ত ব্যক্তির যা করণীয় তা হলো—

  • কনুইয়ের বিশ্রাম

  • প্রয়োজনে এলবো ব্যাগ ব্যবহার

  • বরফ ও তাপ প্রয়োগ (যখন যেটা প্রয়োজন)

  • প্যারাসিটামল সেবন করা যেতে পারে

  • বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত

পরিহার করুন
এই রোগ পরিহারে আপনার সচেতনতাই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে স্ট্রেচিং ব্যায়াম ও এলবো ট্রেনিং করতে হবে।

অনেকেই হঠাৎ মাথাব্যথায় ভোগেন

শরীরের মাথাব্যথা বা ফাইব্রোমায়ালজিয়া
মিসেস আইরিন (৩৪) গৃহিণী, সারা শরীরে ব্যথা, অবসাদ, ঘুম, ক্লান্তি তাঁকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। অনেক ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছেন। কোনো বিশেষ অসুবিধা নির্ণয় হয়নি এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। কোনোভাবেই তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। এখানে ফাইব্রোমায়ালজিয়া নামক একটি রোগ নিয়ে আলোচনা করছি।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া কী
ফাইব্রোমায়ালজিয়া বা ফাইব্রোমায়ালজিয়া সিনড্রোম একটি দীর্ঘস্থায়ী মনোদৈহিক রোগ, যা সারা শরীরে ব্যথার উদ্ভব করে।

উপসর্গ

  • সারা শরীরে ব্যথা

  • ব্যথায় সারা শরীর জমে থাকা

  • শরীর ভার লাগা

  • অবসন্নতা

  • শরীর ম্যাজম্যাজ করা

  • কাজে অনীহা

  • অনিদ্রা

রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ দেখে সাধারণত এই রোগ নির্ণয় করা যায়। যেহেতু অনেক জটিল রোগেও এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তাই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য জটিল রোগ থেকে এই রোগ আলাদা করা যায়।

লক্ষণ
শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া। ব্যথার প্রচণ্ডতা অনেক সময় আবহাওয়া ও পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও বদ্ধ পরিবেশ, অতিরিক্ত শব্দযুক্ত পরিবেশে কাজ, কাজের ও মানসিক চাপ এবং ঋতুস্রাবের আগে ব্যথা বেশি অনুভূত হতে পারে। হতাশা, দুশ্চিন্তা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা বা দূরে থাকা, পারিবারিক অশান্তি—এই রোগ সৃষ্টির কারণ হতে পারে।
কে আক্রান্ত হতে পারেন

সারা বিশ্বে প্রতি ২০ জনে একজনের এই রোগ দেখা যায়। সাধারণত ২০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীরা এতে বেশি আক্রান্ত হন।

রোগ নির্ণয়
রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ দেখে সাধারণত এই রোগ নির্ণয় করা যায়। যেহেতু অনেক জটিল রোগেও এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তাই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য জটিল রোগ থেকে এই রোগ আলাদা করা যায়।

চিকিৎসা ও পুনর্বাসন
সত্যিকার অর্থে এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এই রোগে কেউ বিকলাঙ্গ হয় না বা স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করেন না এবং এটা ক্যানসার বা এই জাতীয় কোনো মারাত্মক ব্যাধির প্রাথমিক লক্ষণও নয়। তবে এটা ঠিক যে এই ব্যথা ও দুর্বলতা তাঁদের প্রাত্যহিক কর্মজীবনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, ছন্দপতন হচ্ছে পারিবারিক ও দাম্পত্যজীবনে। অফিসে কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে এবং ক্রমেই আনফিটের দিকে এগোচ্ছেন। তাই এই রোগের নিয়ন্ত্রণে পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরি।

  • লেখক: বাতরোগ, ব্যথা ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা