আঙুল ফুলে কলাগাছ—প্রবাদটি অনেকেই শুনেছেন। আজ বলব কান ফুলে আলুগাছের গল্প।
রেহনুমার শখ ছিল কানের দুল পরার, তাই বিয়ের আগে আগে কানের লতিতে ছিদ্র করেন। তাঁর স্বামী মধ্যপ্রাচ্য থেকে বেশ সুন্দর কয়েক জোড়া কানের দুল আনেন। কিছু ঝুমকোর মতো, কিছু খুব ছোট স্বর্ণের দুলের মাঝে ঝিকিমিকি পাথর বসানো। রেহনুমা কানের পাশেও দুল পরার জন্য ছিদ্র করেন। রেহনুমার দেখাদেখি তাঁর বোন মায়মুনাও কানের ছিদ্র করান, তবে শুধু কানের লতিতে। দুলগুলো পরতে পেরে রেহনুমা খুশি। মায়মুনাও খুশি নিজেকে বড় বড় লাগছে ভেবে।
পৃথিবীর এক অদ্ভুত নিয়ম হলো, সুখ ক্ষণস্থায়ী। বিয়ের মাস দুয়েক পর জামান সাহেব মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে রেহনুমা আর মায়মুনা দুজনের কানের ছিদ্রগুলোর চারপাশ কেমন জানি ফুলে যেতে লাগল। মায়মুনা ভয়ে দুল খুলে রেখে দিলেন। রেহনুমা কানের পাশের দুলগুলো খুলে রাখলেও সামাজিক ও পারিবারিক চাপে পড়ে কানের লতির দুলগুলো খুলতে পারলেন না।
দিনে দিনে দুই বোনের কানের ফোলাগুলো বাড়তে লাগল। এর মধ্যে আশপাশের সবার বুদ্ধিতে মায়মুনার কানে উল্টোপাল্টা ওষুধ লাগানো হলো, ফলে এক কানের ফোলাতে ঘা দেখা দিল।
এভাবে ছয় মাস পর যখন তাঁরা দুজনেই মেডিকেলের আউটডোরে দেখাতে এলেন, তখন দুজনের কানে দশাসই গোটা। রেহনুমার কানে ছয়টি, আর মায়মুনার কাছে দুটি। এর মধ্যে রেহনুমার লতির গোটার বৃদ্ধি এমনভাবে হয়েছে যে কানের দুলগুলো ভেতরে ঢুকে গেছে। আর মায়মুনার এক পাশে গোটা, ওপরের চামড়া ভালো, তবে অন্য পাশে ঘা। তাঁদের অনেক বুঝিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হলো দ্রুত।
কী হয়েছিল তাঁদের
তাঁদের যেটা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘কিলয়েড’ (Keloid)। অনেকের শরীরের গঠনই এ রকম যে কোনো ক্ষত বা আঘাতের স্থানের ত্বক সুস্থ হতে থাকলে সেখানে এ ধরনের ত্বকে মোটা গোটা তৈরি হয়, যা দিন দিন আকারে বাড়তে থাকে। সাধারণত কানের লতিতে, কানের পাশে বা নাভিতে ছিদ্র করা হলে সেখানে এ ধরনের গোটা হতে পারে।
এমন হলে কী করবেন?
প্রথমত, ঘাবড়াবেন না। এটা কানের খুবই সাধারণ একটি রোগ। তাই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
দ্বিতীয়ত, স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, অজ্ঞাত ওষুধ, অচিকিৎসা বা অপচিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো কিছু ব্যবহার করবেন না। এতে কানের চামড়া স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কানের সংক্রমণ হয়ে ‘পেরিকন্ড্রাইটিস’ হয়ে পুরো কানের আকার পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, নাক-কান-গলার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা পদ্ধতি
সাধারণত আমাদের দেশে যে চিকিৎসা প্রচলিত আছে তা হলো, যত্নের সঙ্গে কানের চামড়া যতটুকু রাখা যায়, ততটুকু রেখে এই গোটাগুলো কেটে ফেলা। কাটা অংশের চামড়া সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ পর সেলাই কাটা হয়। গোটা কাটানোর ১৪ দিন পর চামড়া পুরোপুরিভাবে ভালো হয়ে গেলে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া হয়। প্রতি মাসে একটি করে, প্রতি অপারেশনের স্থানে, ছয় মাস। এর ফলে সেলাইয়ের স্থানে ফের গোটা হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়।
উন্নত দেশে অনেক সময় ফের গোটা হওয়া ঠেকাতে রেডিওথেরাপি দেওয়ারও চল আছে।
রেহনুমা ও মায়মুনার কথায় ফিরে যাই। ছয় মাস পর হলেও তাঁরা চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। তাঁদের গোটাগুলো কেটে ফেলা হয়। তারপর যথারীতি সেলাই কাটা ও স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে তাঁরা দুজনেই ফলোআপ করাতে আসেন। এখন পর্যন্ত রেহনুমা ও মায়মুনার কান পুরোপুরি ভালো। রেহনুমা সাহস করে আবার কানের লতিতে ছিদ্র করিয়েছেন। মায়মুনা আর করেননি। তবে রেহনুমা কানের পাশে ছিদ্র করানোর ব্যাপারে চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছেন।
সুখের সময় হয়তো দীর্ঘ হয় না। তবে চিকিৎসক ও রোগীর যথাসময়ে যথাযথ যোগাযোগ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।
সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদে থাকুন। সুখে থাকুন সবাই।
লেখক: এমবিবিএস (ইউএসটিসি-১৮), বিসিএস (স্বাস্থ্য), ডিএলও ট্রেইনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।