My Heart, Your Heart অর্থাৎ ‘আমার হার্ট, তোমার হার্ট’। এটি এ বছরের বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান। এ স্লোগানের অন্তর্নিহিত বিষয় হলো, সব সমমনা মানুষকে একীভূত করা ও হার্টের সুস্থতা বিষয়ে একতাবদ্ধ হওয়া। এই স্লোগান সঙ্গে নিয়ে প্রতিবছরের মতো এ বছরও পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বব্যাপী হৃদরোগ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য এ দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন ও ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন যৌথভাবে বিশ্ব হার্ট দিবস পালনে সম্মত হয়। এই হার্ট দিবস সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন ১৯৯৭-৯৯ সেশনে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্বে থাকা অ্যান্থনি বেইস ডি লুনা।
প্রথম হার্ট দিবসটি পালন করা হয় ২০০০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববারটি বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা হতো। পরবর্তী সময় ২০১১ সাল থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশে হৃদরোগের ঝুঁকি
বিশ্বজুড়ে এখন মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো হৃদরোগ। প্রতিবছর বিশ্বে যে পরিমাণ লোক মারা যায় তার ৩১ শতাংশ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। এখন যে হারে হৃদরোগ হচ্ছে, তাতে আগামী ২০৩০ সালে সারা বিশ্বে ২৩ মিলিয়ন লোক মারা যাবে। হৃদরোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ভৌগোলিক কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে হৃদরোগে ঝুঁকি বেশি। কারণ আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়সে ধূমপান করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। কোন খাবার স্বাস্থ্যকর আর কোনটা অস্বাস্থ্যকর, সে বিষয়ে আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা কম। আবার ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম। এর ফলে তাদের হার্টের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে, যা সাধারণত অল্পতেই কোলেস্টেরলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
আমাদের দেশে কম বয়সেও হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে
হৃদরোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে এনজাইনা বা হার্ট অ্যাটাক। এনজাইনা হচ্ছে, রোগীর সাধারণত বুকব্যথা, চাপ চাপ অনুভব করা, বুক ভার ভার হওয়া, দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হওয়া ইত্যাদি। কারও করোনারির ৭০ শতাংশ ব্লক হয়ে গেলে তখনই এনজাইনা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এনজাইনা থেকে হার্ট অ্যাটাক হয়। আবার করোনারি ধমনি যখন ১০০ শতাংশ ব্লক হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষের এটি হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষের ১০ বছর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এখন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী, এমনকি ২৫-৩০ বছর বয়সী মানুষও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া এ অঞ্চলে হার্ট বড় হওয়া ও হার্টের ভালভের কিছু রোগ পাওয়া যায়। হার্টের ভালভের রোগ হয় মূলত বাতজ্বরের কারণে। শৈশবে যাঁদের বাতজ্বর ছিল, তাঁদের পরবর্তী সময়ে হার্টের ভালভ আক্রমণ করে। এর মধ্যে কিছু রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। আর কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
যাঁরা অল্প বয়স থেকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেছেন, তাঁদের করোনারি ধমনিতে স্পাজম হয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে অথচ এনজিওগ্রাম করে করোনারি ধমনিতে ব্লক পাওয়া যায় না, অর্থাৎ এমন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্লাকশন উইথ নো অবস্ট্রাকটিভ করোনারি Atherosclerosis (MINOCA)। এ অবস্থায় রোগীর করোনারি ধমনিতে ব্লক ছাড়াও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
হৃদরোগের ঝুঁকি প্রতিরোধ ও করণীয়
দুই ধরনের রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে। কখনো কখনো রিস্ক ফ্যাক্টর প্রতিরোধ করা যায়-যেমন: ধূমপান বর্জন করে, মদ্যপান না করে, শাকসবজি বেশি বেশি খেয়ে, চর্বি পরিহার করে হৃদ্রোগের কিছু রিস্ক কমানো যায়। কিন্তু যদি কারও পরিবারে হৃদ্রোগের ইতিহাস ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকে, সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। হার্ট সজীব ও শক্তিশালী করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন: স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম, হাঁটাহাঁটি, সাঁতার, সাইকেল চালানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান না করা এবং ছন্দোবদ্ধ জীবনযাপনের মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো ও প্রতিরোধ সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। কোনো ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সাধারণত ECG, ECHO, রক্তের পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়, রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো এসপিরিন গ্রুপের ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে রক্ত পাতলা করা। এরপর প্রয়োজনীয় আধুনিক চিকিৎসা যেমন- Primary Angioplasty করে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণ করা। যদি রোগীর Cardiac Arrhythmia বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হয়, তবে এই অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের সমস্যা মোটেও অবহেলা করা যাবে না। কেননা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের ফলে আবার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাই হার্ট অ্যাটাকের প্রথম ৪৮-৭২ ঘণ্টা অনবরত ECG মনিটরিং করে দেখতে হবে, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের সমস্যা আছে কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি হার্ট অ্যাটাকের পর ২-৩ দিন রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। অবস্থা স্থিতিশীল হলে চিকিৎসকদের দায়িত্ব, রোগীকে কাউন্সেলিং করে খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও পরবর্তী চিকিৎসা যেমন- Angiogram কখন করাবে ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করা।
হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায়
হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল অর্থাৎ Coronary Angiogam করে কখনো কখনো রিং পরানো বা বাইপাস সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে, যার ব্যয়ভার সবার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধই উত্তম। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে, যাতে হৃদরোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। এ বছর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’-এর প্রতিপাদ্য বিষয়: My Heart, Your Heart। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো অসংক্রামক ব্যাধিজনিত মৃত্যুর হার হ্রাস করা এবং অল্প বয়সে হৃদরোগজনিত কারণে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। তাই বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হৃদরোগ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা এবং আমার, আপনার হার্টের সুস্থতা ধরে রাখা। কেননা, হার্টের প্রতিটি স্পন্দনই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাসচিব, অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিসিয়ান্স অব বাংলাদেশ