করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। অনেকে আবার বলছেন, আমাদের দেশে প্রথম ঢেউ এখনো শেষ হয়নি। যে যা–ই বলুক, করোনাভাইরাস এখনো আমাদের জীবনে এক আতঙ্কের নাম। এই আতঙ্ক বহুগুণ বেড়ে যায় যদি বাড়িতে ক্যানাসারে আক্রান্ত একজন রোগী থাকেন।
করোনা একটি ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাস। স্পর্শ ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এই ভাইরাস তাদেরই খুব সহজে আক্রান্ত করতে পারে, যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তাদের ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণের যাবতীয় জটিলতাও বেশি। ক্যানসারের রোগীরা এর মধ্যে অন্যতম।
ক্যানসার রোগীদের রোগের কারণে এবং ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে যে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়, সে কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সাধারণ সুস্থ মানুষের তুলনায় কমে যায়। আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার প্রথম ব্যূহ হিসেবে কাজ করে যে বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা, তার সংখ্যা ও পরিমাণ যায় কমে। ফলে রোগী সহজেই জীবাণুর সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তার ওপর আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর রক্তে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট রসদ তৈরি হয় না। সব মিলিয়ে এ সময় ক্যানসার রোগীরা খুবই নাজুক অবস্থায় আছেন।
করোনার প্রকোপ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব, জানি না। কিন্তু এই দীর্ঘ অনিশ্চিত সময় ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এ–ও সত্য যে ক্যানসার নির্ণয়ের পর যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল। দেরি হলে তা আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কীভাবে ক্যানসার রোগীরা এই করোনাকালে সতর্কতা অবলম্বন করে নিরাপদে চিকিৎসা নিতে পারেন, সেদিকে নজর দিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ক্যানসার নিয়ে কাজ ও গবেষণা করে এমন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা করোনাকালে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যাপারে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রকাশ করেছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ক্যানসারের চিকিৎসকেরা এই দিকনির্দেশনা মেনে কাজ করে চলেছেন। তবে এর পাশাপাশি ক্যানসার রোগীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
১. ক্যানসার রোগীদের প্রয়োজন ছাড়া অহেতুক সামান্য বিষয়ে ঘন ঘন হাসপাতালে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময় যতটা সম্ভব অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার সময় গণপরিবহন ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত পরিবহন করা ভালো।
২. নিয়মিত ফলোআপ ও ছোটখাটো সমস্যার সমাধানে যদি টেলিমিডিসিনের ব্যবস্থা থাকে, তবে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো।
৩. বিশেষ প্রয়োজনে হাসপাতালে গেলেও ক্যানসার রোগীদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী, বিশেষ করে মাস্ক সব সময় ব্যবহার করা উচিত। বাড়ি না ফেরা অবধি কিছুতেই মাস্ক খোলা যাবে না।
৪. অবশ্যই হাসপাতালে যেখানে জনসমাগম বেশি, সেসব জায়গা পরিহার করা উচিত। আগেই সময় নিশ্চিত করে যাওয়া ভালো, যাতে বেশিক্ষণ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে না থাকতে হয়।
৫. হাসপাতাল তথা সব ক্ষেত্রে ক্যানসার রোগীদের অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।
৬. ক্যানসারের চিকিৎসা, বিশেষ করে কেমোথেরাপি নিলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় বলে এসব চিকিৎসা নেওয়ার পর কিছুদিন আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ধরনের রোগীকে ‘শিল্ড’ করে রাখার কথা বলা হয়, মানে একেবারে লক্ষণরেখা তৈরি করে প্রতিরক্ষাব্যূহের মধ্যে রাখতে হবে।
৭. বাড়িতে থাকলেও বারবার ভালোভাবে সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে।
৮. নাকে, মুখে, চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারও সঙ্গে হাত মেলানো যাবে না। কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের সময় মাস্ক পরতে হবে।
৯. চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হবেন না। বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান, জনসমাগমে কিছুতেই যাবেন না।
১০. ঘরের যেসব জায়গায় বারবার হাত দিতে হয় (দরজার ছিটকিনি, হাতল, সুইচ, মুঠোফোন ইত্যাদি) বারবার জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
১১. বাড়ির যে সদস্য বাইরে কাজে যান, তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। ক্যানসার রোগীর ঘরে ভিড় করা যাবে না বা সবাই মিলে যাবেন না। একজন ব্যক্তি, যিনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, তিনি রোগীর সেবাশুশ্রূষা করবেন। অবশ্যই রোগীর ঘরে প্রবেশের আগে হাত ভালো করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে মুখে মাস্ক পরে ঢুকবেন। বাড়িতে বা হাসপাতালে কোনো অতিথির সঙ্গে দেখা করবেন না।
করোনাকালে ক্যানসার রোগীর সচেতনতা বিষয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন থাকে। সেসব প্রশ্নের পরামর্শ দেওয়া হলো—
একজন ক্যানসার রোগী বা ক্যানসার সারভাইভারের জ্বর, দুর্বলতা, স্বাদহীনতা বা গলাব্যথার মতো উপসর্গ হলে কী করা উচিত?
পরামর্শ: যেহেতু এ ধরনের ব্যক্তি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আছেন। তাই কোভিড-১৯-এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রথমে টেলিফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। উপসর্গ তীব্র না হলেও চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব আলাদা বা আইসোলেশনে নিতে হবে।
একজন ক্যানসার রোগী কী করোনাভাইরাসের টিকা নিতে পারবেন?
পরামর্শ: ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী বা ক্যানসার সারভাইভারদের করোনাভাইরাসের টিকা নিতে কোনো বাধা নেই।
টিকা নেওয়ার আগপর্যন্ত কী করে একজন ক্যানসার রোগী নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখতে পারে?
পরামর্শ: নিজে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করে, সামাজিক দূরত্ব সঠিকভাবে বজায় রেখে এবং সব ধরনের ভিড় থেকে দূরে থেকে একজন ক্যানসার রোগী নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে যাবেন। এমনকি টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
একজন ক্যানসার রোগীর বাড়িতে বা ঘনিষ্ঠ কারও কোভিড হলে কী করবেন?
পরামর্শ: দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীকে পুরোপুরি আইসোলেটেড করে ফেলবেন। অবশ্যই সন্দেহভাজন স্বজন থেকে দূরত্ব অবলম্বন করতে হবে। বাড়ির অন্যরা, বিশেষ করে গৃহকর্মী ও শিশুদের মাধ্যমে রোগ যেন না ছড়ায় সে দিকেও সতর্ক নজর রাখবেন। দরকার হলে উপসর্গ না থাকলেও বাড়ির অন্যরাও ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও করোনার নমুনা পরীক্ষা করে নেবেন।