স্ত্রীরোগ ক্যানসার সচেতনতার মাস চলছে। প্রতীকী এই ছবির মডেল: কুমকুম, এলভিন ও জিনিয়া
স্ত্রীরোগ ক্যানসার সচেতনতার মাস চলছে। প্রতীকী এই ছবির মডেল: কুমকুম, এলভিন ও জিনিয়া

এই ৩ ক্যানসার শুধু নারীদের হয়, চিকিৎসা কী?

স্ত্রীরোগ ক্যানসার সচেতনতার মাস—সেপ্টেম্বর। নারীদের বেশি হয় এমন চার ধরনের ক্যানসারের কথা জানাচ্ছেন বিআরবি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট, গাইনিকোলজিস্ট ও গাইনি অনকোলজিস্ট ডা. ফারহানা তারান্নুম খান

ক্যানসারের কিছু উপসর্গ আছে, যেগুলো নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও লজ্জায় ভোগেন অনেক নারী, বিষয়টা গোপন রাখার চেষ্টা করেন। স্বজনদের কাছে খোলাসা করে কিছু বলেন না, চিকিৎসকের কাছেও যেতে চান না। ফলে রোগ শনাক্ত হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এসব কারণে নারীদের ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো সুফল পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেও অনেক নারী চিকিৎসা নিতে দেরি করেন। অথচ নারীদের বেশির ভাগ ক্যানসারই ঠিক সময়ে শনাক্ত হলে সফলভাবে আরোগ্য করা সম্ভব। এ বিষয়ে চাই ব্যাপক সচেতনতা।

জরায়ুমুখ ক্যানসার

বিশ্বে চতুর্থ হলেও বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের পরই জরায়ুমুখ ক্যানসারের অবস্থান। অথচ এটি এমন একটি ক্যানসার, যা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করাও সম্ভব। উন্নত দেশগুলোয় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক কম হলেও নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় এই ক্যানসারে শতকরা ৯০ ভাগ রোগীই মারা যান। সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছরের নারীরা এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) নামক একটি গোত্রের ভাইরাস দিয়ে জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়ে থাকে।

কাদের ঝুঁকি বেশি: বাল্যবিবাহ বা কম বয়সে সহবাস, অধিক সন্তান ধারণ, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, বহুগামিতা, দীর্ঘদিন একাধারে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, ধূমপান, প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে ও এইচআইভি আক্রান্ত নারীদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি।

লক্ষণ: প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের কোনো লক্ষণ না–ও থাকতে পারে। তবে সহবাসের পর রক্তক্ষরণ, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার রক্তপাত, অতিরিক্ত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত বা চাল ধোয়া পানির মতো স্রাব, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, যোনিপথ দিয়ে প্রস্রাব বা পায়খানা নির্গত হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি।

প্রতিরোধে করণীয়: ১. ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদান: ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই টিকা দেওয়া যাবে। তবে যৌনমিলন শুরুর পূর্বে দিলে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায়। সরকার বিনা মূল্যে কিশোরীদের এই টিকা দেওয়া শুরু করেছে। তাই দেরি না করে আপনার কন্যাশিশুকে অবশ্যই টিকার আওতায় আনবেন।

২. স্ক্রিনিং টেস্ট: অন্যান্য ক্যানসারের সঙ্গে জরায়ুমুখ ক্যানসারের একটি বড় পার্থক্য হলো স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে এটি ক্যানসার–পূর্ব অবস্থায়ই নির্ণয় করা সম্ভব। ক্যানসার–পূর্ব অবস্থায় চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসার হওয়া থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, নারীও স্বাভাবিক নারীত্ব বজায় রাখতে পারে। স্ক্রিনিং টেস্টগুলোর মধ্যে রয়েছে এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট, প্যাপ টেস্ট ও ভায়া টেস্ট। তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর এসব টেস্ট করা উচিত। অনেকেই জানতে চান যে টিকা দিলে স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে কি না। তাঁদের জানা জরুরি যে টিকা দিলেও স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে।

৩. এ ছাড়া কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে না দেওয়া, অধিক সন্তান ধারণ থেকে বিরত থাকা, নিরাপদ যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, ধূমপান না করা, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলা ইত্যাদি।

শনাক্ত করার উপায়: উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে জরায়ুমুখের বায়োপসি করে ক্যানসার শনাক্ত করা হয়।

চিকিৎসা: স্টেজের ওপর ভিত্তি করে সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিয়ে এই ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়।

ডিম্বাশয়ের ক্যানসার

ক্যানসার

ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারকে বলা হয় নীরব ঘাতক। প্রাথমিক অবস্থায় এর তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরে অনেকটা ছড়িয়ে পড়ার পর উপসর্গ প্রকাশ পায়। ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নারী প্রজননতন্ত্রের ক্যানসারগুলোর মধ্যে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার সবচেয়ে মারাত্মক। এর কোনো ক্যানসার–পূর্ব অবস্থা নেই, যাতে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি প্রতিরোধ করে যেতে পারে। যেকোনো বয়সের নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের জার্ম সেল নামক ডিম্বাশয়ের ক্যানসার এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বিশেষত ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী নারীদের এপিথেলিয়াল ওভারিয়ান ক্যানসার বেশি দেখা যায়।

উপসর্গ: ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের নির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ নেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুধামান্দ্য বা অরুচি, পেট ফুলে যাওয়া, অল্প খাবারে পেট ভরা বা পেটে অস্বস্তি অনুভূত হওয়া, পেটে পানি আসা, বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব, ওজন কমে যাওয়া, পেটে চাকা অনুভব করা, পেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, সহবাসে ব্যথা, অনিয়মিত প্রস্রাব–পায়খানা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসিকের অনিয়ম দেখা দিতে পারে।

করণীয়: এসব উপসর্গ দেখা দিলে অথবা যাঁদের ডিম্বাশয়, স্তন বা জরায়ু ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাঁরা অবহেলা না করে দ্রুত গাইনিকোলজিস্টের শরণাপন্ন হয়ে শারীরিক চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করতে পারবেন।

চিকিৎসা: এটির মূল চিকিৎসা সার্জারি। পাশাপাশি কেমোথেরাপি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া হয়। রোগীর বয়স, সন্তান নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, ক্যানসারের ধরন ও স্টেজের ওপর ভিত্তি করে কনজারভেটিভ রেডিক্যাল সার্জারি করা হয়ে থাকে।

জরায়ু বা ইউটেরাইন ক্যানসার

উন্নত দেশের নারীদের মধ্যে এই ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। তবে দিন দিন নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেও এর প্রকোপ বাড়ছে। ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে মেনোপজের পর এই ক্যানসার হয়। তবে ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ৪০ বছরের আগেই নারীরা এই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন।

কাদের ঝুঁকি বেশি: বয়স্ক ও স্থূলকায় নারী, যাঁরা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খান, যাঁরা পিসিওএসে আক্রান্ত অথবা বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন, যাঁদের সন্তান সংখ্যা কম, মেনোপজাল হরমোনথেরাপি নিচ্ছেন, যাঁদের কম বয়সে মাসিক শুরু হয়েছে আর বেশি বয়সে বন্ধ হয়েছে, যাঁদের জরায়ু কোলোন ও ওভারিয়ান ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

উপসর্গ: মেনোপজের আগে নাকি পরে ইউটেরাইন ক্যানসার দেখা দিয়েছে, তার ওপর উপসর্গ নির্ভর করে। মেনোপজের আগে অনিয়মিত মাসিক, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হলে সতর্ক হতে হবে। মেনোপজের পর রক্তপাত বা রক্তযুক্ত স্রাব, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, পায়খানা–প্রস্রাব অনিয়মিত হওয়া, পেটে চাপ অনুভব করা ইত্যাদি ক্যানসারের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে।

রোগ নির্ণয়: উপসর্গ দেখা দিলে একটি ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রাফি ও প্যাপ টেস্ট করার পর চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য ডি অ্যান্ড সি অথবা হিস্টরোস্কোপির মাধ্যমে বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়। ক্যানসারের ধাপ নির্ণয়ের জন্য এমআরআই করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসা: স্টেজের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হলেও মূল চিকিৎসা সার্জারি অর্থাৎ ডিম্বাশয়সহ জরায়ু ফেলে দেওয়া। ক্যানসার যেসব জায়গায় ছড়াতে পারে, সেগুলো অপসারণ করার দরকার হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনভেদে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোনথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে।

ক্যানসারের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়। রোগ বা উপসর্গ নিয়ে লজ্জা বা আতঙ্কে না ভুগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে সুফল বেশি। এ ছাড়া ক্যানসার চিকিৎসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিয়মিত ফলোআপ। চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার পরও একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর চিকিৎসকের কাছে গিয়ে শারীরিক পরীক্ষা ও কিছু টেস্টের মাধ্যমে রোগটির ফিরে আসা বুঝতে পারা যায়। নারীদের এসব ক্যানসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে পরিবারের সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে।