আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে। মানুষের শরীর আয়োডিন তৈরি করতে পারে না, তাই আমাদের খাবারের সঙ্গে তা গ্রহণ করতে হয়।
বেশির ভাগ আয়োডিন আমরা দৈনন্দিন খাদ্য ও পানীয় থেকে পাই। সাধারণত সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। তাই সামুদ্রিক উৎস থেকে পাওয়া খাবার (যেমন সমুদ্রের মাছ) আয়োডিনসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিছু শাকসবজি (যেমন পালংশাক, বিট, টমেটো ও মরিচ) ভালো মাত্রায় আয়োডিন থাকে, যদি সেগুলো আয়োডিনসমৃদ্ধ মাটিতে জন্মে। আবার কিছু সবজি আছে (যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম) যেগুলো শরীরে আয়োডিন শোষণে বাধা দেয়। ফলে এসব সবজি বেশি খেলে শরীরে আয়োডিনের মাত্রা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন প্রয়োজন। থাইরয়েড হরমোনের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আয়োডিন। থাইরয়েড হরমোন আমাদের শরীরে বিপাকসংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। থাইরয়েড হরমোন প্রধানত মস্তিষ্ক, মাংসপেশি, হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে অপরিহার্য।
যখন আমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দেয় তখন প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন হয় না এবং আমরা আয়োডিনের অভাবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগি, যেগুলোকে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বা ইংরেজিতে আয়োডিন ডিফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার (আইডিডি) বলা হয়ে থাকে। এসব সমস্যার কয়েকটি—
হাইপোথাইরয়েডিজম
আয়োডিনের অভাবে যখন শরীরে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। এর ফলে আলসেমির ভাব, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, অনিদ্রা, চামড়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
গলগণ্ড
আয়োডিনের ঘাটতির প্রাথমিক ও দৃশ্যমান লক্ষণ হলো গলগণ্ড রোগ। আমাদের গলদেশে যে থাইরয়েড গ্রন্থি আছে, তা যখন আয়োডিনের অভাবে ফুলে যায় তখন তাকে গলগণ্ড রোগ বলা হয়। আগেই বলা হয়েছে, আয়োডিনের অভাবে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না। এ অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করার চেষ্টা করে। মূল উপাদান আয়োডিনের ঘাটতি থেকে যাওয়ার পরও যখন গ্রন্থিটি আয়োডিন তৈরির বৃথা চেষ্টা করে তখন তা আকারে বড় হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি চোখে পড়ে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং একপর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।
প্রজনন সমস্যা
গর্ভকালীন থাইরয়েড হরমোন শতকরা ৫০ শতাংশ বেশি উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোনের জন্য বেশি মাত্রার আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। গর্ভধারণের ১১ সপ্তাহ থেকে ভ্রূণের থাইরয়েড গ্রন্থি কাজ শুরু করে। ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ পূর্ণ হলে ভ্রূণ তার নিজস্ব থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন শুরু করে। সেই সময় থেকে শিশুর তিন বছর বয়স পর্যন্ত সঠিক মাত্রার আয়োডিন গ্রহণ মা ও শিশু উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রূণের বৃদ্ধিও সময় মস্তিষ্ক এবং অন্ত্র খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ সময় আয়োডিনের অভাব হলে বা পর্যাপ্ত আয়োডিন না পেলে মস্তিষ্কেও স্থায়ী ক্ষতিসহ আয়োডিন ঘাটতিজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের খুব বেশি অভাব দেখা দিলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে। এই সন্তান বেঁচে থাকলেও জন্মগত নানা সমস্যায় ভোগে। এর ফলে সন্তান হাবাগোবা হয়, ভালোভাবে কথা বলতে পারে না কিংবা একেবারে বোবা হয়, কানে কম শোনে এবং শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় বামন আকৃতির থেকে যায়।
শিশুমৃত্যু
আয়োডিনের অভাবগ্রস্ত শিশুরা অন্যান্য শিশুর চেয়ে বেশি মাত্রায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে এবং তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। ফলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে।
আমরা সঠিক মাত্রায় আয়োডিন খাচ্ছি কি না, তা পরিমাপ করা যায় প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত আয়োডিনের পরিমাণ থেকে। নানা রকম খাবারের মাধ্যমে আমরা যে আয়োডিন খাই তার শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তাই প্রস্রাবে আয়োডিনের মাত্রা জানার মাধ্যমে বুঝতে আমরা সঠিক পরিমাণে আয়োডিন খাচ্ছি কি না। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের শরীরে আয়োডিনের অবস্থা পরিমাপ করার জন্য তাদের প্রস্রাবে আয়োডিনের মাত্রা একটি ভালো সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতি লিটার প্রস্রাবে গড়ে আয়োডিনের মাত্রা যখন ১০০-২০০ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায় তখন বুঝতে হবে শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি নেই।
প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত আয়োডিনের সঙ্গে আয়োডিন গ্রহণের সম্পর্ক বোঝানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থা নিচের সারণি ব্যবহার করে থাকে:
আয়োডিনের এই ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার জন্য আমাদের অবশ্যই খাদ্যের সঙ্গে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। এর সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উপায় হলো খাবারের মাধ্যমে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া। আমাদের দেহে বেশি আয়োডিন জমা থাকে না, তাই নিয়মিত অল্প পরিমাণে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ শুষ্ক স্থানে, সূর্যের আলো থেকে দূরে এবং আবদ্ধ পাত্রে রাখতে হবে। না হলে লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যাবে।