কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল হলেও আম খাওয়ার মানুষ বেশি, এটা আম খাওয়ার আমজনতা। আমাদের মৌসুমি ফলের মধ্যে জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। মানুষ অপেক্ষা করে আম খাওয়ার জন্য ডায়াবেটিস রোগীদের নিষেধ থাকলেও আম খাওয়ার বায়না থাকেই। আমকে ফলের রাজা বলা হয়, আর এই ফলকে সবাই কমবেশি পছন্দ করেন। এই ফলের উৎস আমাদের দেশে বা অঞ্চলে। ভারতবর্ষে ছয় হাজার বছর আগে আমের চাষ শুরু হয়। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও এই ফলের উল্লেখ পাওয়া যায়। পৃথিবীতে আম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রতিবছর এক মিলিয়ন টনের বেশি আম বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়।
আমরা আম কাঁচা ও পাকা খেয়ে থাকি। আমের আছে নানা স্বাস্থ্যকর দিক। সেই সঙ্গে দুটি ভিন্ন স্বাদে আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছে আম। আম অনেক জাতের হয়ে থাকে, এক গবেষণার তথ্যে জানা গেছে, পৃথিবীতে ৩৫১টি আমের জাত আছে, যার অর্ধেকের বেশি ভারতীয় অঞ্চলেই জন্মায়।
কাঁচা বা পাকা দুই ধরনের আমই শরীরের জন্য ভালো। কাঁচা বা পাকা যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, আম সব বয়সী মানুষের শরীরের জন্য ভালো। আমের আঁশে কিছু উপাদান, যেমন ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, আছে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম। এ ছাড়া আমে প্রায় ২৫ রকমের বিভিন্ন কেরাটিনোয়েডস উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে; আছে বিটাক্যারোটিন, ভিটামিন ই, সেলেনিয়াম এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যাসিড, যেমন টারটারিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড ও সাইট্রিক অ্যাসিড। ভিটামিন এ, প্রোটিনসহ আরও অন্যান্য উপাদানও থাকে। ১০০ গ্রাম কাঁচা আমে পটাশিয়াম থাকে ৪৪ ক্যালরি এ ছাড়া ৫৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি ও ২৭ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
• বাইরে তীব্র রোদের ঝাঁজের সঙ্গে গা-পোড়ানো গরম, এ সময় কাঁচা আমের এক গ্লাস শরবত বানিয়ে খেলে সারা শরীরে এনে দিতে পারে প্রশান্তি।
• যাঁরা ওজন কমাতে বা শরীরের বাড়তি ক্যালরি খরচ করতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ ফল কাঁচা আম। পাকা মিষ্টি আমের চেয়ে কাঁচা আমে চিনি কম থাকে বলে এটি ক্যালরি খরচে সহায়তা করে।
• বুক জ্বালাপোড়া বা অম্লতার সমস্যা, ঢেকুর ওঠা থেকে কাঁচা আম মুক্তি দিতে পারে; অম্লতা কমাতে কাঁচা আমের এক টুকরো মুখে দিতে পারেন।
• ঘুম থেকে সকালে উঠে বমি বমি ভাব হয়; বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বাদের। এ সমস্যা দূর করতে পারে কাঁচা আম এই অস্বস্তি কমাবে।
• লিভারজনিত সমস্যা প্রাকৃতিক বন্ধু কাঁচা আম। কাঁচা আম চিবিয়ে খেলে পিত্তরস বৃদ্ধি পায়। এতে লিভারের স্বাস্থ্য ভালো হয় এবং অন্ত্রের জীবাণু সংক্রমণ রোধে কাজ করে।
• রক্তের আয়রন ঘাটতি পূরণে কাঁচা আম ভালো, রক্তাল্পতা সমস্যা সমাধানে বেশ উপকারী।
• খাদ্য হজমে সহায়তা করে কাঁচা আম এবং পাকা আম অন্ত্রকে পরিষ্কার করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়।
• শরীরে লবণের ঘাটতি দূর করে।
• কাঁচা আম খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
• কাঁচা আম শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি জোগায়, যা স্কার্ভি ও মাড়ির রক্ত পড়া কমায়। আয়ুর্বেদ মতে, আমচুর স্কার্ভি নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী। এ ছাড়া নিশ্বাসের দুর্গন্ধ ও দাঁতের ক্ষয় রোধেও সহায়তা করে।
• কাঁচা আম খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে।
• পাকা আম ত্বক সুন্দর, উজ্জ্বল ও মসৃণ করে ত্বকের ভেতর ও বাইরে থেকে উভয়ভাবেই সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের লোমের গোড়া পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে ও ব্রণের সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
• পাকা আমের আঁশ ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টসমৃদ্ধ থাকায় তা হজমে সহায়তা করে। প্রচুর পরিমাণে এনজাইম আমাদের শরীরের প্রোটিন অণুগুলো ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে, যা হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
• আমে প্রায় ২৫ রকমের বিভিন্ন কেরাটিনোয়েডস উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে, যা ইমিউন সিস্টেমকে সুস্থ ও সবল রাখে।
• বিটাক্যারোটিন, ভিটামিন ই এবং সেলেনিয়াম থাকায় পাকা আম হার্টের সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
• আমে রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, যা আমাদের শরীরের স্নায়ুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ সচল রাখে। আমাদের শরীরকে সতেজ রাখে, যার কারণে আম খেলে ঘুম পায়, ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি আম খেলে ঘুমের সমস্যা দূর হবে।
• মৌসুমে প্রতিদিন আম খেলে শরীরে ভিটামিন এ-এর চাহিদা প্রায় ২৫ শতাংশ পূরণ হবে, যা চোখের জন্য খুবই উপকারী, চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে।
• আমে প্রচুর পরিমাণে টারটারিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড ও সাইট্রিক অ্যাসিড আছে, যা আমাদের শরীরে অ্যালকালাই বা ক্ষার ধরে রাখতে সহায়তা করে, শরীরে লিপিড ঠিক রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
• পাকা আমের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। স্তন, লিউকেমিয়া, কোলন ও প্রোস্টেট ক্যানসারের মতো মারাত্মক ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
• পাকা আম পটাশিয়ামসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি আমাদের হার্টবিটকে সচল রাখে ও রক্তাল্পতা নিয়ন্ত্রণ করে।
• পাকা আম আমাদের শরীরের রক্ত পরিষ্কারে সহায়তা করে। প্রতিদিন আম খেলে দেহের ক্ষয়রোধ হয় এবং স্থূলতা কমিয়ে দেয়।
• আমে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, সেই সঙ্গে আরও আছে ফাইবার, যা সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়, রক্তে উপস্থিত খারাপ কোলেস্টেরল, কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
মানুষ আম খাওয়ার জন্য রাতকে বেছে নেয়; অথচ ওটাই আম খাওয়ার খারাপ সময়। সকাল থেকে বিকেল—যেকোনো সময় আম খাওয়া যায়। আম সলিড খাবার ভাত-রুটি খাওয়ার আগে খেতে পারলে ভালো। জুস খেলে পরেও খাওয়া যাবে। তবে কাঁচা আম কোনো অবস্থায় দুপুরের পর খাওয়া ঠিক না।
কথায় আছে, অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়। অতিরিক্ত পরিমাণে আম খেলে ডায়রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ কাঁচা আমের কষ মুখে লাগলে ও পেটে গেলে মুখ, গলা ও পেটে সংক্রমণ হতে পারে।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ
ছবি: প্রথম আলো