মানুষের জন্মের পর ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত হাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। আবার ৪০ বছরের পর থেকে প্রাকৃতিকভাবেই এ ঘনত্ব কমতে থাকে। অর্থাৎ, ক্ষয় হতে থাকে। ক্ষয় যদি আগেই শুরু হয়, কিংবা বেশি মাত্রায় হয়, তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হলেও বেশির ভাগ মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত তা বুঝতে পারে না।
মানুষকে অস্টিওপোরোসিস বিষয়ে সচেতন করতে ২০ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘এসকেএফ অস্টিওপোরোসিস দিবস’। অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল ‘অস্টিওপোরোসিসের কারণ ও প্রতিরোধে জিজ্ঞাসা’। চিকিৎসক তেহরীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থোপেডিক বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আহসান।
অনুষ্ঠানটি ২০ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও।
এ পর্বে অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আহসান অস্টিওপোরোসিসের ধরন সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি জানান, অস্টিওপোরোসিস সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক, অ্যাকোয়ার্ড বা অর্জিত; দুই, সাধারণ অস্টিওপোরোসিস। দ্বিতীয়টির প্রাদুর্ভাবই বেশি। সাধারণ অস্টিওপোরোসিস আবার দুই ধরনের—প্রাইমারি অস্টিওপোরোসিস এবং সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস। প্রাইমারি অস্টিওপোরোসিসের আবার দুই ধরনের রয়েছে। টাইপ ওয়ান এবং টাইপ টু। এটা সাধারণত নারীদের হরমোন–সম্পর্কিত সমস্যা, ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে দেখা দেয়। তখন শরীরে একটি বিশেষ হরমোন তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং সমস্যা বাড়তে থাকে। রোগ–সম্পর্কিত বা অভ্যাসগতভাবে যেটা হয়ে থাকে সেটি হলো, সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস।
নারীদের হাড়ের গঠন ধরে রাখা খুবই দরকারি। ৪৪ বা ৪৫ বছর পর যখন নারীদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রথম ১০ বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। যদি আগে থেকে এটা প্রতিরোধ না করা যায় বা হাড়ের গঠনের জন্য কোনো ওষুধ দেওয়া না হয় তাহলে দেখা যায়, তাঁরা খুব অস্বাভাবিক হয়ে যান; শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে।
আর টাইপ টু সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে হয়ে থাকে। ৬০-৭০ বছর বয়সে প্রায় সব নারী–পুরুষের ক্ষেত্রেই এটি দেখা যায়। অস্টিওপোরোসিসের আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন পরিবারের কারও অস্টিওপোরোসিস থাকলে নিজের এটি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কম ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া। স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার। কায়িক শ্রম না করা। নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন, ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ।
অস্টিওপোরোসিস শরীরে বাসা বাঁধার পেছনে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি বড় ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আহসান বলেন, হাড়ের বৃদ্ধিতে ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি হাড়ের সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জিত হলেও নিয়মিতভাবে ক্যালসিয়াম গ্রহণ দরকার। কেননা, এটা অস্থিক্ষয়ের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে। অস্টিওপোরোসিস রোধে খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ভিটামিন ডি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এটি দেহে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে হাড়ের গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সূর্যের আলো ভিটামিন ডি–এর প্রধান উৎস। তা ছাড়া কিছু মাছ ও ডিমের কুসুমে সামান্য পরিমাণ ভিটামিন ডি রয়েছে। বয়স্ক ও যাঁরা সব সময় বাসায় থাকেন, তাঁরা ভিটামিন ডি–এর অভাবে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। কারণ, তাদের পক্ষে সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণ সম্ভব হয় না। বিশেষজ্ঞরা সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণের ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত দুইবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ৫ থেকে ১৫ মিনিট রোদে থাকার পরামর্শ দেন।
খাবার গ্রহণেও রয়েছে সতর্কতা। কেননা, কিছু কিছু খাবার এখনই পরিহার না করলে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। আমরা অনেকেই নিজেদের অজান্তে প্রতিদিন এসব খাবার খেয়ে চলেছি। যেমন অতিরিক্ত লবণ, অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইডযুক্ত খাবার। লবণ দেহ থেকে ক্যালসিয়াম বের করে দিয়ে হাড়কে দুর্বল করে দেয়। চিপস, বিভিন্ন ফাস্ট ফুড, কাঁচা খাবার বা সালাদে মেশানো লবণ হাড়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ছাড়া খাওয়ার সময় বাড়তি লবণ খাওয়াও হাড়ের জন্য বেশ ক্ষতিকর। চা ও কফির ক্যাফেইনও হাড়ের ক্ষয়ের জন্য দায়ী। চা বা কফি যদি সঠিক মাত্রায় পান করা যায়, তাহলে খুব একটা ক্ষতির কারণ নেই।
অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিনও অস্টিওপোরোসিসের জন্য দায়ী। তাই মাংস খাওয়া কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত মাংস মানেই অতিরিক্ত প্রোটিন। এ প্রোটিন শরীরে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি করে, যাকে নিষ্ক্রিয় করতে ক্যালসিয়াম কাজ করে। যার ফলে হাড়ে ক্যালসিয়াম কম পৌঁছায়। এতে হাড়ের ক্ষতি হয়। বর্তমান সময়ে ছেলে-বুড়ো সবারই পছন্দের তালিকায় আছে সফট ড্রিংকস। এটিও প্রতিনিয়ত হাড়ক্ষয় করে। কোমল পানীয়ে রয়েছে ফসফরিক অ্যাসিড, যা প্রসাবের মাধ্যমে দেহের ক্যালসিয়াম শরীর থেকে বের করে দেয়। যার ফলে অস্থি ক্ষয়ে যেতে থাকে।