‘ইউটিউব ভিডিও বানিয়ে তুমি জীবিকা নির্বাহ করো!’

জ্যাক কিং একজন মার্কিন ইউটিউবার। তাঁকে ডিজিটাল মাধ্যমের জাদুশিল্পীও বলতে পারেন। মূলত ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনার সময়ই এই জাদুটা তিনি দেখান। ইউটিউব, টিকটকসহ একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জ্যাক তুমুল জনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের বায়োলা ইউনিভার্সিটির এই স্নাতক নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাবর্তন বক্তা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন এ বছর। পড়ুন তাঁর বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ।

জনপ্রিয় ইউটিউবার জ্যাক কিং ও তাঁর দলের সদস্যরা

মা-বাবা-দাদা-দাদি, যাঁরা উপস্থিত আছেন, শুভেচ্ছা নেবেন। আমি একজন ইউটিউবার। জিনিসটা কী, পরে নাহয় আপনাদের সন্তানদের কাছ থেকে জেনে নেবেন।

প্রিয় স্নাতকেরা, তোমাদের মতো মেধাবী আমি নই। তবে হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় এতই গভীর মনোযোগ দিয়েছিলাম যে চার বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পাঁচ বছর লেগেছিল। এক দশকেরও আগে আমার স্নাতক শেষ হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আজ মনে হচ্ছে, আমি আমার বাড়ি ফিরেছি।

এখানে এসে সেফটি অফিসারকে দেখে আগের মতোই দৌড়ে পালাতে নিচ্ছিলাম। ক্যাম্পাসে যা যা করেছি, আর যা যা করিনি, সেসবের জন্য আজ সুযোগ পেয়ে ক্ষমা চেয়ে নিই। মেঝেতে সাবানের ফেনা ছিটানো, লাইব্রেরিতে রাতের বেলা ক্যাম্পিং, জিমের ভেতর খেলনা বিমান নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া, ডর্মে ‘ডাঙ্ক ট্যাংক’ বানাতে গিয়ে পুরো ভবন পানিতে ভাসিয়ে ফেলা, কী করিনি!

ড. কোরে (বায়োলা ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ডক্টর ব্যারি এইচ.) যখন সমাবর্তন বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানালেন, ভাবছিলাম এমন কী বলতে পারি, যা তোমরা মেধাবীরা গত চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শোনোনি। ছোটখাটো একটা অঙ্ক কষে বের করলাম, ক্যাম্পাসে তোমরা প্রায় ১৮ শ ঘণ্টা ক্লাস করেছ। পাগল! অতএব আমি খুব বেশি কিছু বলতে যাব না। শুধু তিনটি ধাপের কথা বলব। এই তিনটি ধাপ পেরোতে পারলেই দাপটের সঙ্গে তুমি পৃথিবী চড়ে বেড়াতে পারবে।

প্রথম ধাপ: প্রত্যাখ্যানের জন্য তৈরি থাকো

বায়োলা ক্যাম্পাসে প্রথমবার আসার স্মৃতিটা তোমাদের কার কার মনে আছে? আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। ওই যে লাইব্রেরিটা দেখছ, ওটার সামনে দাঁড়িয়েই ঠিক করেছিলাম, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ব। কী আমাকে টেনেছিল? না, চলচ্চিত্র বিভাগের কেবিনেট ঠাসা শুটিংয়ের অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি নয়। এই ক্যাম্পাসে মেয়ে ও ছেলের অনুপাত ৩: ১, সেটাও নয়। আমি বায়োলাতে এসেছিলাম; কারণ, এখানে স্কুটার চালিয়ে ক্লাসে যাওয়া যায়। এখন আর এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু আমার সময়ে এটা বেশ একটা ‘কুল’ ব্যাপার ছিল।

স্কুটার চালিয়ে ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নটা আমার শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ল। কারণ, আমি ফিল্ম স্কুলে সুযোগ পাইনি। পেছনে তাকিয়ে এখন মনে হয়, ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতেই আমাকে এই প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু সেই সময়ে এটা ছিল ভীষণ কষ্টদায়ক।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জ্যাক কিং

ফিল্ম স্কুল আমাকে যদি প্রত্যাখ্যান না করত, নতুন একটা ওয়েবসাইটের সঙ্গে হয়তো পরিচিতই হতাম না। যে ওয়েবসাইটের নাম ‘ইউটিউব ডটকম’। অনুমান করি, তোমাদের বয়স তখন ছয়। তাই সময়টা সম্পর্কে একটু ধারণা দিই। তোমাদের মা-বাবা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, তখন মাত্রই প্রথম আইফোনটা বাজারে এসেছে। নেটফ্লিক্স তখনো লাল খামে ভরে বাড়ি বাড়ি ডিভিডি পাঠাত। ইনস্টাগ্রাম তখনো আবিষ্কারই হয়নি।

প্রত্যাখ্যান দুটি কাজ করে। প্রথমত, তোমাকে ঠেলে দেয় এক অপ্রত্যাশিত পথে। সেই পথে পা বাড়িয়েই ইউটিউবের সঙ্গে আমার পরিচয়। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাখ্যান আমাদের একটা প্রশ্নের মুখোমুখি করে, ‘আমি আসলে কে?’ আমিও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলাম। চলচ্চিত্রনির্মাতা যদি না-ই হই, তাহলে আমি আদতে কী হতে চাই?

আজকের দিনে কথাটা শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে। কিন্তু এটা সত্যি যে তুমি যা হতে চাও, সেটা হওয়ার জন্য কিন্তু ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। সামনের দিনগুলোতে তুমি বহু প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হবে। আমিও হয়েছি। আমি বই লেখার চেষ্টাও করেছিলাম। মুখের ওপর ‘না’ বলে দিয়েছেন প্রকাশক।

সে যাকগে। ধরে নিচ্ছি তোমরা এখন প্রত্যাখ্যানের জন্য তৈরি। এবার তাহলে দ্বিতীয় ধাপে যাই।

দ্বিতীয় ধাপ: ঝুঁকি নাও

জুয়া খেল। ক্যাসিনোতে গিয়ে নয়, বাজি ধরো নিজের ওপর। অর্থাৎ ঝুঁকি নাও।

মিথ্যা বলব না। যেদিন তোমাদের মতো, আমিও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বসেছিলাম, মা-বাবা-স্বজনদের হাসিমুখে বলছিলাম, ‘খুব ভালো লাগছে। জীবনের নতুন অধ্যায় নিয়ে আমি খুবই রোমাঞ্চিত।’ কিন্তু সত্যি বলতে আমার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। যে পেশার দিকে যাচ্ছিলাম, সেটার ব্যাপারেও খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। কারণ, ইউটিউব তখনো পেশাক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি।

আমার বন্ধুরা যখন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পা রাখতে প্রস্তুত, আমি তখনো গ্যারেজে বিড়ালের ভিডিও বানাতে ব্যস্ত। ইউটিউব থেকে যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া দেওয়া কিংবা আরও ১০ জনের বেতন দেওয়া তো দূর, ‍দুপুরের খাবারে ২ দশমিক ৯৯ ডলারে অ্যালবার্টনের স্পেশাল চিকেন বেছে নেওয়াটাও কঠিন হয়ে যেত।

একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম। ওর বাবা জানতে চাইলেন, ‘তুমি তাহলে ইউটিউব ভিডিও বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ কর!’ প্রশ্নটা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল। তাঁর কণ্ঠে শ্লেষ মেশানো অবিশ্বাস ছিল। সেই লোক আজ আমার শ্বশুর।

গ্র্যাজুয়েশনের এক বছর পরও ইউটিউবার ক্যারিয়ার নিয়ে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না। এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা চাকরির ডাক এল। ডিসকভারি চ্যানেলের ভিডিও প্রযোজক হতে হবে, ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থায়ী চাকরি, ৬ অঙ্কের বেতন...সবই বেশ লোভনীয়। আমি তখন মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত—এটাই আমার পথ। কয়েকটা ইন্টারভিউ পেরিয়ে যখন শেষ ইন্টারভিউতে পৌঁছলাম, কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে টেবিলের ওপাশের মানুষটা সেই চিরাচরিত, সহজ প্রশ্নটাই করলেন—

‘আমার কাছে তোমার কোনো জিজ্ঞাস্য আছে?’

আমার বলা উচিত ছিল, ‘নাহ! তোমার প্রস্তাবটা তো দারুণ। বেতনও বেশ ভালো। আমি রাজি।’

কিন্তু কেন যেন দোনোমনা শুরু করলাম। বললাম, ‘আমি তো আসলে ইউটিউবে ভিডিও বানাই, চাকরিটা আমার জন্য কি না, আমি ঠিক নিশ্চিত নই ...’

তিনি যা বললেন, শুনে খুব অবাক হলাম, ‘বাহ, এটা তো দারুণ। তোমার তো নিজের ওপরই ঝুঁকিটা নেওয়া উচিত।’ কে জানে, তিনি হয়তো আমাকে নিতে চাননি। কিন্তু দিন শেষে চাকরির প্রস্তাবটা আমি ফিরিয়েই দিলাম। খুব শান্তি লাগল!

এই ইন্টারভিউয়ের এক সপ্তাহ পরই এমন একটা ভিডিও আপলোড করি, যা আমার জীবন বদলে দেয়। কদিন পর আবিষ্কার করলাম, ভক্তদের সঙ্গে সেলফি তুলছি আর মন ভরে অ্যালবার্টনের স্পেশাল চিকেন খাচ্ছি!

তোমার পরিবার তোমাকে নিয়ে কী ভাবে, বন্ধুরা কী ভাবে, সেসবের ওপর নয়; তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও, তার ওপরই বাজিটা ধরো।

তৃতীয় ধাপটা তুলনামূলক সহজ। প্রথম আর দ্বিতীয় ধাপের মধ্য দিয়ে বারবার যাও; একসময় দেখবে, পৃথিবী তোমার। কিন্তু আমি তোমাদের কাছে আজ শুধু একটা প্রতিজ্ঞাই চাই। কথা দাও, যে সাফল্যের জন্য তুমি পা বাড়াচ্ছ, একদিন সেই সাফল্য যদি পেয়েও যাও, তখনো বিনীত আর সহানুভূতিশীল থাকবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত