২০০৬ সালের কথা। তখন মিশনারিজ স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। থাকি ওদের হোস্টেলে। আর মিশনারিজ বোর্ডিং স্কুল মানেই কড়া নিরাপত্তা, শাসনের বেষ্টনী। কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার তো দূরের কথা, টিভি দেখার নিয়মও ছিল না। একমাত্র পাঠ্যবই ছাড়া বাকি সবকিছুতেই ভয়ংকর রকমের কড়াকড়ি। যেন ‘ধরা পড়লেই হাজতবাস’। ছোটবেলা থেকেই দস্যি মেয়ে হিসেবে আমার ‘খ্যাতি’ ছিল। আর সেই বিশেষণ মিশনারিজ স্কুলেও অক্ষত ছিল। সে সময় একটা বিশ্বকাপের ম্যাগাজিন বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। হোস্টেলে সেটাই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে গিয়ে চোখ আটকে গেল ১৮ বছর বয়সী এক আর্জেন্টাইন তরুণের ছবির দিকে।
ছোটখাটো ছেলেটা একটা ভ্যাবলা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে, মাঝারি বাদামি চুল। নাম তাঁর লিওনেল মেসি। জন্ম আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে। আমার পদবিও রোজারিও। আমার আনন্দ দেখে কে! ছেলেটাকে মনে ধরল বেশ। ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ কথাটি তখন কিশোরীদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়। আমার তা–ই হলো। প্রথম দেখায় মেসিকে মন দিয়ে দিলাম। হোস্টেলের শ্যামলদাকে লুকিয়ে টাকা দিলাম স্কচটেপ কেনার জন্য। সেটা দিয়ে যত্ন করে মেসির ছবিটা ম্যাগাজিন থেকে কেটে নিজের হাতে লেমিনেশন করলাম। যাকেই সামনে পেতাম, ছবি দেখিয়ে বলতাম, এবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে এক নতুন প্লেয়ার খেলবে। ও কিন্তু আমার প্রেমিক। সবাই শুনে হাসত। ক্লাসের কিছু বন্ধু আবার আমার এই পাগলামিকে পূর্ণ সমর্থনও জানিয়েছিল।
শুরু হলো বিশ্বকাপ ২০০৬–এর আসর। কিন্তু মুশকিল হলো, খেলা দেখব কীভাবে। আমাদের তো টিভি দেখার নিয়ম নেই। এদিকে বিকেল গড়ালেই খেলা। যেই ভাবা সেই কাজ। কলতলায় গেলাম প্লেট ধোয়ার নাম করে। আর গিয়েই পিচ্ছিল জায়গায় ধপাস করে পড়ে গেলাম ইচ্ছা করে। বন্ধুরা অবশ্য জানত, এটা আমার অভিনয়। বিকেলের মধ্যেই ‘ব্যথায় কাতর’ আমাকে দেখে হোস্টেল সুপার বাড়ি পাঠিয়ে দিল। সত্যি! সেদিনের মতো খুশি আমি খুব কমই হয়েছি। কেবলই মনে হচ্ছিল, প্রেমিকের জন্য এইটুকু করতে পারব না!
ম্যাগাজিনের পাতায় মেসির ছবি দেখে আমি যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি হলাম ওর খেলা দেখে। এখানে বলে রাখা ভালো, মেসি যখন আমার ‘প্রেমিক’, তখনো কিন্তু মেসি ‘মেসি’ হয়ে ওঠেনি। প্রথম খেলা তো আছাড় খেয়ে দেখলাম। পরের খেলাগুলো কীভাবে দেখব? অন্য বুদ্ধি বের করলাম।
পরের খেলায় রাতে স্টাডি টেবিলে, এমনকি গোটা হোস্টেলেও আমাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। বন্ধুদেরও বলিনি কিছু। আমাদের হোস্টেলের পাশেই সিস্টারদের দোতলা কনভেন্ট বিল্ডিং। তার নিচের হলরুমেই এক কোনায় টিভি। হলরুমের কর্নারেই গা ঘেঁষে গোলাপ বাগান। আরও কিছু ফুল, ফল আর ঔষধি গাছও ছিল। সিস্টারদের টিভিতে খেলা শুরু হলো। আর আমি খালি পায়ে, পা থেকে নূপুর জোড়া খুলে চুপিসারে বাগান পেড়িয়ে পানির ট্যাংকের নিচে গুটিসুটি মেরে খেলা দেখতে লাগলাম। দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যেত না। কিন্তু আর্জেন্টিনা কোনটা আর মেসি কোনটা, বুঝতে পারতাম। ওতেই শান্তি। তবে এর মূল্যও চুকাতে হলো। কিছুদিন বাদে বাগানের মশার কামড়ে আমার ডেঙ্গু হয়ে গেল। মেসির খেলা দেখার জন্য এমন কাণ্ড কোনো ১৩ বছরের কিশোরী করেছে কি না, কে জানে!
তখন প্রথম আলো পত্রিকা আর সাপ্লিমেন্টারি থেকে কেটে কেটে মেসির সব ছবি ডায়েরির পাতায় আটকে রাখতাম। সেটার জন্যও বিশাল যুদ্ধ করেছি। যেহেতু পাঠ্যবই বাদে কোনো কিছু পড়ার নিয়ম ছিল না, তাই অন্য পথ খুঁজে বের করেছিলাম। পেপার না পড়লে খেলার খবর জানব কী করে! সিস্টাররা সকালের নাস্তার টেবিলে বসলেই লুকিয়ে দৌড় দিতাম হলরুমের দিকে। পাহারায় রাখতাম আমার দুই বান্ধবীকে। এই সুযোগে আমি পেপারে থাকা মেসির সব ছবি কেটে নিতাম। ভাগ্যিস, তখন সিসি ক্যামেরা ছিল না। ধরা পড়লে সোজা টিসি। সিস্টাররা মাঝে চিরুনি অভিযান চালালেন। পেপারে শুধুই টেক্সট, মেসির কোনো ছবি নেই!
বেশ কিছুদিন পর প্রথম আলোতে মেসির আরেকটা ছবি ছাপা হলো। কিন্তু সেখানে সে একা নয়। সঙ্গে তার প্রেমিকা আন্তোনেল্লা রোকুজ্জো। অবকাশযাপনে গিয়ে পাপারাজ্জির ক্যামেরায় ধরা পড়ল তারা। মনে আছে, ওদের ছবি দেখে সে কি কান্না! কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না রোকুজ্জোকে। বুকে পাথর চেপে শুধু সেই ছবিটাই আমি কাটিনি। মনে মনে অভিমান হলো ভীষণ। আসলে, আমি বিশ্বাস করেই নিয়েছিলাম যে মেসি আমার প্রেমিক, মেসি শুধু আমার।
সেই প্রেমিকাকে বিয়ে করে মেসি এখন তিন সন্তানের বাবা। এখন ২০২২ সাল, চলছে বিশ্বকাপ। আমার দেখা সেই ১৮ বছরের তরুণ ছেলেটা কত্ত বড় হয়ে গেছে! আমিও আগের পাগলামির কথা ভেবে হাসি। সেই সময় বন্ধুদের ডেকে বলতাম, স্প্যানিশ শিখব দেখিস। মেসির জন্য ভিনদেশি ভাষায় কবিতা লিখব, সাংবাদিক হয়ে স্পোর্টস রিপোর্টিং করব। তারপর একদিন সাক্ষাৎকার নিতে যাব। আর সামনাসমনি সেই সাক্ষাৎকারের এক ফাঁকে মেসি ঠিক আমার প্রেমে পড়ে যাবে। বাকিটা...
এত কিছু লেখার একটাই কারণ—ফুটবলের প্রতি প্রেম যে ছেলেটাকে দেখে আর তার খেলা দেখে, এবার তার শেষ বিশ্বকাপ। ২০০৬ থেকে ২০২২—এই ১৬ বছরের জার্নিতে মেসি আর আমি দুজনেই জীবনযাত্রায় কত পথ পার করে ফেললাম। ভাগ্যিস ছেলেটা জন্মেছিল, নাহলে আমার কৈশোরের প্রেমটা জমত না কোনো দিন। সবকিছু কি আর ধরা দেয়? বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষটির মনেও কিছু আক্ষেপ আছ। তাতে কি!
যদি কোনো দিন সৌভাগ্য হয় আমাদের দেখা হবে। আর সেদিন আমি কী করব? আমার এই লেখাই স্প্যানিশ ভাষায় পড়ে শোনাব মেসিকে। আজ রাতের খেলার জন্য শুভকামনা আর ভালোবাসা ছোট্টবেলার প্রেমিক—লিও।