সৈয়দ শামসুল হক জন্মেছিলেন কুড়িগ্রামে। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, শিশুসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্যের সব শাখায় সমানভাবে অবদান রেখেছেন বলেই তাঁকে বলা হয় সব্যসাচী লেখক। লেখালেখির আগ্রহ যাঁদের আছে, তাঁদের জন্য সৈয়দ শামসুল হকের লেখা অবশ্যপাঠ্য। বিশেষ করে তাঁর মার্জিনে মন্তব্য বইটি নিশ্চয়ই তরুণদের কাজে আসবে। তাই ভাষার মাসে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বইটির অংশবিশেষ রইল আজ।
আমি দেখেছি, লিখতে চান এমন প্রায় অনেকের কাছেই প্রধান এবং গোপন একটি দুর্ঘটনা হচ্ছে—তাঁদের ভাব আছে ভাষা নেই। আমার লেখক জীবনে কম করে হলেও শ দুয়েক মানুষ আমাকে বলেছেন, যদি ভাষার ওপর তাঁদের দখলটা থাকত।
থাকলে কী হতো? দখলটা থাকলে তাঁরা লিখতেন!-বাংলাদেশকে দুলিয়ে দিতেন!-এবং খ্যাতির রোদ্দুরে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতেন! এঁদের অনেকে আবার এত দূর মনে করেন যে কেবল তাঁরা কলম ধরছেন না বলেই দ্বিতীয় শ্রেণির লেখকেরা বাজার গরম করে রেখেছেন: যদি তাঁরা লিখতেন, যদি তাঁদের ভাষাটা থাকত তাহলে বর্তমান লেখকেরা রণে ভঙ্গ দিতেন!
আবার কিছু তরুণ লেখককে আমি খেদের সঙ্গে উচ্চারণ করতে দেখেছি যে ভাষাটা এখনো তাদের দখলে নেই। আর প্রায়ই এমন পুস্তক সমালোচনা আমার চোখে পড়ে, যেখানে দুঃখ প্রকাশ করা হয়, আলোচিত লেখকটি ভাষার দিকে আর একটু মনোযোগ দিলে পারতেন!
আমার মনে হয়, এসব কথার গোড়াতেই একটা ফাঁক আছে। ধরেই নেওয়া হয়েছে যে ভাব এবং ভাষা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। অর্থাৎ, সাহিত্যিক প্রয়োজন ও প্রেরণার ক্ষেত্রে ভাষা ছাড়াই ভাব এসে পড়তে পারে; কিংবা ভাষাটা আয়ত্তেও আছে, কেবল জুতসই একটা ভাবই আপাতত হাতে নেই।
কিন্তু তাই কি?
সাহিত্য থাক, দৈনন্দিন জীবনের দিকে তাকানো যাক। আমাদের ভেতরে ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ আছে, সুখ–দুঃখের অনুভূতি আছে, আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা আছে, কিছু চাইবার আছে, কিছু দেবার আছে, শূন্যতা আছে, তৃপ্তি আছে, আর এগুলো আমরা অনবরত প্রকাশ করে চলেছি, প্রধানত ভাষার সাহায্যেই। ভঙ্গি বা অভিব্যক্তি দিয়েও প্রকাশ করি, এর মিশেল তো প্রায় সার্বক্ষণিক, তবে প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ওই ভাষাই।
কই, কখনো তো আমাদের মনে হয় না যে ভাষাটা ঠিক আয়ত্তে নেই বলে মনের ভাবটা প্রকাশ করতে পারলাম না! ক্ষুধার সময় আহার্য চাইতে পারলাম না ভাষার অভাবে, ট্রেন লেট দেখে পাশের লোকটিকে আমার বিরক্তি জানাতে পারলাম না—এমন দুর্ঘটনা আমার অন্তত জানা নেই। হয়তো কেউ বলবেন, এমন অনেকে সত্যিই আছেন, যাঁরা কিছু বলতে পারেন না, এমনকি মুখ ফুটে খাবারও চাইতে পারেন না। আমি বলব, তাঁদের মুখ যে ফোটে না, সেটা ভাষার অভাবের দরুন নয় বরং অনিচ্ছা থেকে; মুখচোরা যিনি, লাজুক যিনি কিংবা স্বভাবতই অপ্রতিভ যিনি, তিনি যে চুপ করে থাকেন, তার জন্যে দায়ী ভাষা নয়, দায়ী তাঁর ব্যক্তিত্ব।
কখনো কখনো প্রয়োজনেই আমরা চুপ করে থাকি। যেমন ধরুন, কারও বাবা মারা গেছেন। মৃতদেহের সামনে তাঁকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। আত্মীয়স্বজন বিলাপ করে চলেছেন; কিন্তু তিনি নির্বাক। তাঁর দুঃখ হচ্ছে, শোক হচ্ছে, কিন্তু ভাষা নেই বলে তিনি তা প্রকাশ করছেন না, তা নয়। এমনকি তিনি যদি বলেনও যে শোকে তিনি পাথর হয়ে গেছেন, বাক্যহারা হয়ে পড়েছেন, তবু বলব তাঁর উক্তিটি সত্য নয়। কারণ, লোকটিই ধরুন, তাঁর প্রবাসী ছোট ভাইকে বাবার মৃত্যুসংবাদ সে রাতেই যে লিখতে বসবেন, সে চিঠিতে তাঁর শোক তিনি ঠিকই প্রকাশ করতে পারবেন, এবং তা প্রতিদিনেই ভাষাতেই। তাঁর শূন্যতা প্রকাশের জন্যে তিনি যে চিঠির পাতা সাদা রেখে দেবেন, এটা কোনো উন্মাদও কল্পনা করবে না।
আমরা অনেক সময় বলি, প্রেমের ক্ষেত্রেই আসুন, যে, ‘তোমাকে কতখানি ভালোবাসি, তাহা ভাষায় বুঝাইয়া বলিতে পারি না।’—এখানে আপনি যদি ধরে নেন যে বক্তা সত্যি সত্যি ভাষার কাছে পরাভব স্বীকার করছে, তাহলে ভুল হবে। আসল ঘটনা এই যে ভাষা ও ভাবই কিন্তু ব্যক্তিটিকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে; ওই যে ভাষায় বোঝানোর অপরাগতা—ওটা আসলে ভাষাতেই বোঝাবার বিশেষ এক রীতি। কিংবা অতিব্যবহৃত একটি পথ।
এখানে জনান্তিকে বলে রাখি, আমরা আমাদের নিবিড়তম, শুদ্ধতম, গভীরতম অনুভূতি ও চিন্তাগুলোকে যতই অসাধারণ এবং অপূর্ব বলে মনে করি না কেন, সেগুলো আমরা যে অতিপ্রচলিত, অতিব্যবহৃত, অতিমলিন শব্দগুচ্ছ ছাড়া, কি উচ্চারণে কি চিঠিতে, প্রকাশ করতেই পারি না—যতই আমরা মনে করি না কেন যে এই নারীকে আমি যেমন ভালো বেসেছি আর কেউ তেমনটি ভালো বাসে নি, তবু যে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’র চেয়ে ভিন্ন বা নতুন কিছু উচ্চারণ করতে পারি না—এখানেই লুকিয়ে আছে অনুভবের বিষয়টির সাহিত্য হয়ে ওঠার প্রধান চাবিকাঠি।
প্রতিদিনের প্রয়োজনের মুহূর্তে ভাষা আমাদের এড়িয়ে যায় না কখনোই। আর এ কথাও বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রয়োজন থেকেই ভাষার জন্ম। মানুষ যেমন সেই সুদূর অতীতে নিজের প্রয়োজনেই নির্মাণ করে নিয়েছে ভাষা, তেমনি আজও মানুষ তার প্রয়োজনের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও তীব্রতার চাপেই ভাষাকে অবিরাম ব্যবহার করে চলেছে। এমনকি নীবরতাকেও আমরা কখনো কখনো ভাষার মতোই, কিংবা ভাষার চেয়েও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলি এই প্রয়োজনের তাড়নাতেই।
প্রতিদিনের জীবনে সাধারণ আমরা, আমরা যাঁরা লেখক নই, যখনই এই নীরবতাকে ব্যবহার করি, যখন কারও প্রশ্নের পিঠে নিরুত্তর থাকি উত্তর থাকা সত্ত্বেও, তখন নিজের অজ্ঞাতেই প্রমাণ রেখে যাই যে ভাব ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক জ্ঞানটি আমাদের রক্তের ভেতরেই আছে।
সম্পর্কটা খুব সোজা করে বলতে গেলে এই যে অনুভূতি যত গভীরই হোক না কেন যে ভাবটি আমার ভেতরে রয়েছে, তাতে কতখানি বিশ্বাস করছি, আমার সমস্ত মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে এরই সমমাত্রায় এনে ভাষার ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করি, এরই সমমাত্রায় সাহস অর্জন করি শব্দ-সন্ধানের অভিযানে বেরিয়ে পড়তে-কেবল শব্দই নয়, এ অভিযান উপমা চিত্রকল্প গদ্যভঙ্গি আবিষ্কারেরও বটে।