যে সমাজের বদ্ধমূল ধারণাই হলো ‘নারীশিক্ষার প্রয়োজন নেই’, সে সমাজে নারী কল্পবিজ্ঞান লিখবে, এমনটা আশা করাই তো দুরাশা! অথচ এমন একটা সমাজেই ১৯০৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দারুণ সার্থক এক কল্পবিজ্ঞান লিখে গেছেন বেগম রোকেয়া। প্রথমে এটি প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজিতে, ‘সুলতানাস ড্রিম’ নামে দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে; পরে সুলতানার স্বপ্ন নামে ১৯২২ সালে নিজেই সেটাকে বাংলায় অনুবাদ ও পরিমার্জন করেন রোকেয়া। ভাবে-ভাষ্যে তাতে কল্পনার পাল্লাটাই হয়তো বেশি, তবে বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোও এত যথার্থভাবে আছে যে চমকে যেতে হয়।
বায়ুযান চালানোর কৌশল, হাইড্রোজেন যে বাতাসের একটি হালকা উপাদান, সে কথাও লিখেছেন তিনি। লিখেছেন সূর্যালোক ব্যবহারের কথা, বৃষ্টিকে ধরার কথা। নিজ গ্রহের সব শক্তি ব্যবহার করতে পারে, এমন এক ‘টাইপ ওয়ান’ সভ্যতাকে তিনি দেখান, যেখানে নেই অপরাধ-অন্যায়-মিথ্যাচার। নারীবাদী এই কল্পবিজ্ঞানে দেখা যায় এক ইউটোপিয়া বা আদর্শ সমাজ, যেখানে পুরুষেরা চার দেয়ালে বন্দী, রোকেয়া যাঁকে বলেছেন ‘মারদানা’। বলপ্রয়োগে নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে পুরুষদের বন্দী করা হয়েছে! নারীর মস্তিষ্ক আকারে পুরুষের চেয়ে ১.১ ভাগ ছোট, কৌশলে সে কথাও বলেছেন রোকেয়া। পাশাপাশি স্পষ্ট ভাষায় এ কথাও বলেছেন, পুরুষের মস্তিষ্ক বড়, তা তো হাতির জন্যও সত্যি। শক্তি বেশি পুরুষের, তা সিংহেরও তো শক্তি বেশি; মানুষ কি তাকে বন্দী করেনি? রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এ রচনা পড়ে বলেছেন ‘নিদারুণ প্রতিশোধ!’ সার্থক কল্পবিজ্ঞান বিষয়ে বলতে গিয়ে জ্যোতির্বিদ ও লেখক দীপেন ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনির কাজ হলো প্রতিষ্ঠিত (বা গৃহীত) সামাজিক ও জৈবিক এবং (এমনকি) বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগতের অবতারণা।’ এ বিবেচনায় রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কালোত্তীর্ণ, যথার্থ ও ক্ল্যাসিক এক কল্পবিজ্ঞান।সুলতানার স্বপ্নর ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই বাংলার নারী লেখকদের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে প্রমীলা কলমে কল্পবিজ্ঞান। লীলা মজুমদার, বাণী বসু, নবনীতা সেনগুপ্তর মতো ওই বাংলার উল্লেখযোগ্য নারীদের লেখা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে শান্তা মারিয়া, তানজিনা হোসেন ও আফসানা বেগমের মতো এই বাংলার নারী সাহিত্যিকদের রচনা। মোট ২০ নারী সাহিত্যিকের কল্পবিজ্ঞান একমলাটে বাঁধা, সংকলন ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন লেখক তৃষ্ণা বসাক। তাঁর নিজেরও একটি গল্প রয়েছে। এসব লেখকের কলমে উঠে এসেছে ভবিষ্যৎ সমাজের ছবি, মূল্যবোধ, প্রেম ও যৌনতার মতো মানবীয় নানা দিক।
সংকলনটি নাড়াচাড়া করে আবারও বোঝা গেল, সুলতানার স্বপ্ন প্রকাশের ১০০ বছর পরও বাংলাদেশে কল্পবিজ্ঞানের জগতে নারীদের বিচরণ সেভাবে বাড়েনি। নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক নাসরীন মুস্তাফা বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন। এরপর আর কারও কথা বলতে গেলে তানজিনা হোসেনের কথাই বলতে হয়।
তানজিনা হোসেন পেশায় চিকিৎসক। কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন বিজ্ঞান কল্পগল্প। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কল্পবিজ্ঞানের নাম আকাশ কত দূর। প্রথমে এটি প্রকাশিত হয় একটি কল্পবিজ্ঞান ম্যাগাজিনে, পরে বই হিসেবে গ্রন্থিত হয় একই নামে। তিনি নিরীক্ষা ধরনের কাজ করেছেন বারবার। দেখিয়েছেন, শুধু সময় পরিভ্রমণ, মহাকাশ বা পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলোতেই কল্পবিজ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়; জিনতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যা, পরিবেশ কিংবা মানুষের মনস্তত্ত্বও হতে পারে কল্পবিজ্ঞানের বিষয়। বিজ্ঞানের হাত ধরে তাঁর লেখায় মূলত প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত নানা বিষয় এবং জীবনের বিচিত্র সব রহস্য উদ্ঘাটিত হতে দেখা যায়। ভবিষ্যতের কল্পনায় ভেসে যাওয়ার চেয়ে সাম্প্রতিক পৃথিবীতে জীববিজ্ঞানের প্রয়োগ দেখা যায় বেশি। তাঁর সাম্প্রতিক বিজ্ঞান কল্পগল্প সংকলন কিনুবালার গান এর আদর্শ উদাহরণ। আর সাম্প্রতিক রচনা ফুসিয়া হাউস-এ রয়েছে জৈবনিক রহস্যের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের দারুণ মিশেল। কিন্তু এ ধারায় তাঁর নিজের আত্মপ্রকাশ কীভাবে? তানজিনা হোসেনের ভাষায়, ‘আমি কল্পবিজ্ঞান পড়ে আনন্দ পাই। যে ধরনের গল্প পড়তে চাই, লিখি তা-ই।’
বাংলাদেশে নারী কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে আফসানা বেগম, শান্তা মারিয়া, রোকসানা নাজনীন, মায়িশা ফারজানা বা মারিয়া কবিরের নামও বলা যায়। তবে তাঁরা ঠিক নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান লেখেন না; লেখেন কালেভদ্রে, একটা-দুটো। ১৯০৫ সালে প্রথম নারীরচিত কল্পবিজ্ঞান পাই আমরা, অথচ তারপর কেবল দুজন নিয়মিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি রচয়িতা পাই! কেন? তানজিনা হোসেন মনে করেন, প্রচলিত যে ধারণা, ‘নারী কবিতা লিখবে, গল্প লিখবে; বিজ্ঞান কেন লিখবে?’ এ ধারণার ভূমিকা আছে অনেকটা।
আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। ভালো কল্পবিজ্ঞান লেখার জন্য ভালো বিজ্ঞান জানা প্রয়োজন। আইজ্যাক আসিমভ বা আর্থার সি ক্লার্ক কিংবা আমাদের হুমায়ূন আহমেদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনের দিকে তাকালেও সেটা বেশ বোঝা যায়। এ দেশে নারীদের বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার অভাব এখনো স্পষ্ট দৃশ্যমান। তবে ধীরে ধীরে তাঁরা এগোচ্ছেন অবশ্যই, গণিত বা ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কিংবা আমাদের নারী গবেষকদের বর্তমান গবেষণায় তার প্রমাণ স্পষ্ট। কিন্তু আরও অনেক দূর এগোতে হবে, আরও অনেক কাজ করা প্রয়োজন নারীদের বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে, এ কথাও অনস্বীকার্য।