তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তবে এখন মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্যই আলোচিত বিল গেটস। ১ ডিসেম্বর কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
আট বছর আগে প্যারিসে এই কপ-এর মঞ্চে দাঁড়িয়েই আমি পৃথিবীকে তিনটি বার্তা দিয়েছিলাম।
১. জলবায়ু সংকট সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
২. সমাধান যদি করতেই চাই, এমন সব উদ্ভাবন করতে হবে, যা আমাদের শূন্য কার্বন নিঃসরণের দিকে নিয়ে যাবে।
৩. আর এই নতুন উদ্ভাবনের জন্যই সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এক হয়েছে।
আট বছর পর অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আপনাদের জানাতে চাই, এক হয়ে কাজ করার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। যদি প্রমাণ চান, কপ-২৮-এর ‘ইনোভেশন হাবে’ উপস্থাপিত উদ্ভাবনগুলো ঘুরে দেখুন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই আট বছর আগে ছিল না।
আপনারা জানেন, কার্বন নিঃসরণকে পাঁচটি খাতে ভাগ করা যায়। জলবায়ুর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এই পাঁচ খাতেই আমাদের শূন্যে পৌঁছাতে হবে।
বৈদ্যুতিক যান ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলো নিয়েই সবচেয়ে বেশি কথা হয়। কিন্তু কার্বন নিঃসরণের জন্য তো মানুষের আরও অনেক কার্যক্রমই দায়ী। সুখবর হলো, আমরা পাঁচটি খাতেই অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।
উৎপাদন খাতের কথা যদি বলি, ইস্পাত তৈরিতে কয়লার বদলে বিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু হচ্ছে। ভবনগুলো আরও সবুজ হচ্ছে। পরিবহন খাতও শূন্য কার্বনের পথে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এ বছরের শুরুতেই নতুন ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার করে একটি স্পোর্টস কার একবারের চার্জে ৬০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। কৃষি খাতে একটি প্রতিষ্ঠান এমন একধরনের জীবাণু তৈরি করেছে, যা সারে ব্যবহার করলে অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমবে।
অনেক দিক থেকেই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পাঁচটি খাতেই কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হলে আমাদের আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। আমি মনে করি, তা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের প্রচেষ্টা জটিল হয়ে পড়ছে দুটি কারণে।
প্রথমত, পৃথিবী এরই মধ্যে উত্তপ্ত হতে শুরু করে দিয়েছে। মানুষ যেন এই প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে, সে জন্য তাদের সাহায্য প্রয়োজন। যারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, আমাদের অগ্রাধিকার তারাই। আমি বলছি সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার সেই কৃষকদের কথা, জলবায়ু সংকটে যাঁদের অবদান সবচেয়ে কম, অথচ তাঁরাই ভুগছেন সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, জলবায়ু পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় আরও ফসল ও গবাদিপশুর উৎপাদনের জন্য চাষিদের সহায়তা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় কারণ, যা আমাদের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে, তা এক শীতল, কঠিন সত্য, অসমতা কমানোর মতো যথেষ্ট সম্পদ পৃথিবীর নেই। এটা ঠিক, আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর সব প্রান্তে আমরা সমান মনোযোগ দিতে পারি না।
স্বল্প সামর্থ্য দিয়ে আমরা হয়তো পরিবেশ, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন—তিন ক্ষেত্রেই একসঙ্গে এগোতে পারব না; কিন্তু স্বল্প কার্বন নিঃসরণের এক পৃথিবী দিয়েই-বা আমরা কী করব, যদি সেই পৃথিবী রোগবালাই, অনাহার, মৃত্যুতে ছেয়ে যায়! তাই আমাদের পথ খুঁজতে হবে, যেন তিনটি সমস্যা সমাধানেই একযোগে কাজ করতে পারি।
সৌভাগ্যক্রমে উদ্ভাবনের সেই শক্তি আছে। উদ্ভাবন দিয়েই আমরা কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি, আবার একই সঙ্গে মানুষের কল্যাণেও ভূমিকা রাখতে পারি।
শিশুমৃত্যুর হারের কথাই ধরুন। ১৯৯০ সালে ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ২০০০ সালে সংখ্যাটা ১ কোটিতে নেমে এসেছে। ২০০৯ সালের মধ্যে আমরা সংখ্যাটা ৫০ লাখের নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।
কীভাবে হলো? পৃথিবীর এই স্বল্প সম্পদই আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক উদ্ভাবনে কাজে লাগিয়েছি: টিকা।
যখনই কোনো খাতে আমরা খরচ করব, তখনই খুব সহজ একটা প্রশ্ন নিজেদের করা উচিত, কীভাবে এই ব্যয় বর্তমান ও ভবিষ্যতে আরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, জীবনের মানোন্নয়ন করতে পারে?
আমার বিশ্বাস, এ প্রশ্নই আমাদের আগামী দশকে পথ দেখাবে। এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জলবায়ু সংকটের সমাধান।
যেসব উদ্ভাবন আরও বেশি মানুষের কাজে আসবে, সেগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করে আমরা শুধু পৃথিবীকে টিকিয়েই রাখব না, করব আরও বাসযোগ্য। ধন্যবাদ।