আমার কোলজুড়ে প্রথম শিশু আসছে। আমার এই আবেগ, এই ভালো লাগা, সুখানুভূতি, সে তো শুধু একজন মা-ই জানেন। অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা...।
ওর জন্য ওর নানু-খালারা নতুন সুন্দর সুন্দর কাঁথা সেলাই করতে লাগলেন। আমি ছোট ছোট জামা, টাওয়েল আরও ভালো লাগার জিনিস কিনতে লাগলাম। আমাকে নিয়মিত যে গাইনোকোলজিস্ট দেখতেন, তিনি ওর সাত মাসের সময় আলট্রাসনোগ্রাম দেখে বললেন, ‘তোমার ছেলে হবে।’ আমার একটু মন খারাপ করল—ভেবেছিলাম, প্রথম সন্তান কন্যা হবে। চিকিৎসকের কথা শুনে তা–ও মনকে প্রবোধ দিতে লাগলাম।
২০০২ সালের ৭ নভেম্বর। অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে সেই দিনটি এল। আমি অপারেশন টেবিলে। আমার গাইনোকোলজিস্ট বোন ডা. সেতারা বিনতে কাসেম এসে আমার কানে কানে বলল, তোর একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। আবেগে আমার দুচোখ বেয়ে তখন আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ছে অনবরত। আমি তো জানতাম, ছেলে হবে; মেয়ে হয়েছে জেনে কান্না থামাতে পারছিলাম না।
তারপর ওকে নিয়ে আমার সম্পূর্ণ একটি নতুন জীবন। আনন্দ আর সুখানুভূতি আর কিছুটা ভয়। প্রতি রাতে ও যখন ঘুমিয়ে থাকত, ওর নাকের কাছে হাত রেখে দেখতাম শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কি না। সে সময় একটু শীত পড়েছিল, তাই ছোট্ট একটি কাপড় দিয়ে ওর মাথাটা ঢেকে রাখতাম, যাতে কান দুটো দিয়ে ঠান্ডা না ঢোকে। কত সতর্কতা ওকে নিয়ে।
এক রাতে ওকে ঘুম পাড়িয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে ওর দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম প্রচণ্ড গরম, আর চোখ দুটো বন্ধ। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। তখন হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাবের চল ছিল, সেই ক্যাবে করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে চললাম। চালককে বলতে লাগলাম, দ্রুত চলেন—ওর ঠোঁটের দুপাশ থেকে ফেনা বেরোচ্ছে। আমার মনের অবস্থা তখন বর্ণনাতীত। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডাক্তারদের কর্মতৎপরতা। এই প্রথম সিজার বা খিঁচুনির কথা জানলাম, দেখলাম। তারপর সারাহকে নিয়ে সাত-সাত দিন হাসপাতালে ছিলাম। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সিটি স্ক্যান আর এমআরআই শেষে জানা গেল এল ওর টিউবেরাস স্কেলেরোসিস।
কী রোগ এটি, আমি নিজেও বুঝতাম না। তখন তো আর হাতের মুঠোয় ইউটিউব, গুগল, এগুলো ছিল না। আর চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, এটি অনেক জটিল একটা রোগ। বাচ্চাদের মনোবিকাশ ঘটে না, বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। আর এই রোগে রোগীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অনেক টিউমার থাকে। টিউমারগুলোর পাশাপাশি অনেক নতুন টিউমার জন্মে, কোনো কিছু দিয়েই যা থামানো যায় না। এগুলো আবার ক্যানসারও নয়।
এই নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে মেয়েকে নিয়ে থাকি। মেয়ের যখন জ্বর হয়, তখনই ওর খিঁচুনি শুরু হয়, আবারও হাসপাতাল, ইমার্জেন্সি। এরই মধ্যে আমার বড় বোন ইয়াসমীন সুলতানার চাকরির সুবাদে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ওখানে কে কে হাসপাতালে সারাহকে নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তারা বলল, এই টিউমারগুলো হতেই থাকে, বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ‘রাপামাইসিন’ বলে একটা ওষুধ আছে, সেটা দিয়ে টিউমারগুলোকে সংকুচিত করে রাখা যায়, কিন্তু ওর ইমিউনিটি (শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) থাকবে না।
ফিরে আসি বাংলাদেশে। সারাহর অনাগত ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হই। মনে মনে কষ্ট পাই। অসহায় আমি নিয়তির কাছে বাঁধা। কী করতে পারি আমি, কতটুকু সাধ্যই–বা আমার আছে!
ওর ৯ বছর বয়সে শিশু নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. নারায়ণ সাহা ওকে একটা ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। যা কিনা ওর সিজার বা খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করবে। সকালে অর্ধেক, রাতে একটি খেতে হবে—এই দিয়েই চলছিল ওর ৯-১৯ বছর পর্যন্ত জীবন।
জ্বর হতো। বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগও হয়েছে। এর মধ্যে যার নাম না উল্লেখ করলেই নয়, শিশু হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস কে রাজ্জাক, আমার দুলাভাই, ডা. সেতারার বর। কোনো অসুখ হলেই ওনার কাছে ছুটে যাওয়া। তিনি সারাহর রোগটি সম্পর্কে জানতেন।
এত কিছুর মধ্যেও সারাহর লেখাপড়া থেমে থাকেনি। প্রথম স্কুল আজিমপুরে লিটল অ্যাঞ্জেলস, নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি। এরপর অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি, হলি ক্রস কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভে ভর্তি আর স্বল্পকালীন অর্থাৎ মাত্র দেড় থেকে দুই মাসের মতো ক্লাসে উপস্থিত হওয়া।
গত মার্চ থেকে সারাহর মাথাব্যথা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। তাকে নিয়ে আইসিইউ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর আবার বাড়ি ফেরা, আবার ইমার্জেন্সি। এরপর ওর মাথা থেকে দুটি টিউমার অপসারণ করা হয়। এরপর ৪৮ ঘণ্টা ওর নিদারুণ শারীরিক যন্ত্রণা, বমি...। কষ্ট বর্ণনাতীত। এরপর আবার আইসিইউ...এরপর সব শেষ।
সারাহ নামের নক্ষত্রটি, আমার কাছ থেকে, এই নশ্বর পৃথিবী থেকে খসে পড়ল।
সারাহ কোনো সাধারণ মেয়ে ছিল না। ও ছিল আলাদা, সবার থেকে আলাদা, বয়সে বড়দের চেয়েও বড়। ওর চারপাশের বেশির ভাগ মানুষগুলোই ওকে বুঝতে পারত না। তবে কিছু মানুষ ওর পরম বন্ধু ছিল, যারা ওর দুঃসময়ে ওকে অনেক সময় দিয়েছে, ওর যন্ত্রণা-কষ্টগুলো লাঘব করার চেষ্টা করেছে, শেষ সময়েও ওর পাশে থেকেছে। ওদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।
ও ছিল মানবপ্রেমী, পশুপ্রেমী। জীবনমুখী চেতনা ওকে অসহায় মানুষদের প্রতি মমতাময়ী করে তুলেছিল। ওদের কিছু দিতে পারা, সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে ওদের কাছে টানা, ভালোবাসায় সিক্ত করা—এগুলো ছিল ওর নিত্যদিনের কাজের অংশ। কে কোন বিপদের মধ্যে আছে, কাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, কাদের জন্য প্রয়োজনে রাস্তায় আন্দোলনে নামতে হবে—সেটি তার জানা, তার প্রতি মুহূর্তের চেতনা।
সারাহ অমর। সারাহ আছে—আমার পৃথিবীতে, আমার সব চেতনায়, সব উপলব্ধিতে।
এই মেয়েটির জন্য আপনারা দোয়া করবেন, যাতে ওর আত্মা ওই পারে পরম শান্তিতে, পরম নিশ্চিন্তে, পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে থাকে। চারপাশের নিষ্ঠুর জগতের কোনো নীচতা, কূপমণ্ডূকতা, সীমাবদ্ধতা, যন্ত্রণা, কষ্ট, অপবিত্রতা ওকে ছুঁতে না পারে।
ও ছিল মুক্ত বিহঙ্গ। তাই হয়তো এই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে সে উড়ে গেল, পৃথিবীর যাবতীয় পঙ্কিলতামুক্ত হতে!