‘পল্লিচিকিৎসক’ বাবা চাইতেন, মেয়ে চিকিৎসক হোক। কিন্তু ফুফুকে দেখে ফৌজিয়া রহমানের মাথায় অন্য চিন্তা ভর করেছিল। বাড়িতেই একটা বিশেষ স্কুল চালাতেন ফুফু। প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াতেন। সেই সুবাদে এই বিশেষ শিশুদের সঙ্গে ফৌজিয়ারও বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে ঠিক করেছিলেন, বড় হয়ে এই শিশুদের জন্য কিছু করবেন।
কিন্তু একসময় সেই স্বপ্ন একটু একটু করে ফিকে হয়ে যায়। তাই শুরুতে বাবার ইচ্ছাতেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেন ফৌজিয়া। হলো না। শেষে ভর্তি হন বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজে। ২০১২ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞান থেকে স্নাতক শেষ করার আগেই নিজের পছন্দে বিয়ে করেন ফৌজিয়া। বিয়ের পর ছেলেবেলার স্বপ্ন পূরণ করতে যুক্ত হন একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে।
স্কুলে সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। ফৌজিয়ার অধীনে তাঁর বিশেষ ছাত্রছাত্রীরাও পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল পেতে শুরু করে। কিন্তু একসময় জীবনে আসে নানা টানাপোড়েন। বিবাহবিচ্ছেদ হয়। হতাশায় একরকম ভেঙে পড়েন বিএম কলেজের এই স্নাতক।
২০১৮ সালে নিজের উদ্যম আর ছোট ভাইয়ের উৎসাহে আবারও পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্ন্যান্স ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে মাস্টার্স প্রোগ্রামে। পাশাপাশি শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ।
মাস্টার্স করার সময়ই আসে ‘টিচ ফর বাংলাদেশে’ ফেলোশিপের সুযোগ। দুই বছরের এই ফেলোশিপে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজের সুযোগ পান ফৌজিয়া। সুযোগ হয় শিশুদের সঙ্গে মেশার। স্কুলের নানা সংকট দেখে শিক্ষা নিয়ে কাজের আগ্রহ তাঁর আরও বেড়ে যায়। ফৌজিয়া বলেন, ‘সত্যি বলতে ছোটবেলা থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চিন্তা করলেও কখনো সিরিয়াসলি চেষ্টা করা হয়নি। টিচ ফর বাংলাদেশের এক আপুর সঙ্গে কথা হওয়ার পর বিষয়টা নিয়ে কাজ করা শুরু করি।’
পৃথিবীজুড়ে তখন করোনা মহামারি। কিন্তু এর মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন ফৌজিয়া। বাংলাদেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যেতে চান, অনেক সময় তাঁদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজি ভাষার দক্ষতা। ফৌজিয়া কীভাবে প্রস্তুতি নিলেন? তিনি বলেন, ‘অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইংরেজির প্রতি আলাদা একটা ভয় কাজ করে। কিন্তু স্কুল–কলেজ থেকেই আমার এ ধরনের ভয় কখনো কাজ করেনি। এটা হয়তো আমাকে কিছুটা সাহায্য করেছে। তা ছাড়া টুকটাক ইংরেজি বলার অভ্যাসও আমার ছিল।’
২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় চিভনিং বৃত্তির জন্য আবেদন করেন ফৌজিয়া। নানা ধাপ পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত ২১ জনের একজন হয়ে সুযোগ পান ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন লিডারশিপ বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন তিনি।
পড়াশোনায় দীর্ঘ বিরতি পড়েছে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক টানাপোড়েন গেছে…এখন বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেছনে ফিরে অবাক লাগে না? ফৌজিয়া বলেন, ‘কখনো কখনো নিজের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু আমি সব সময় আমার প্যাশনের পেছনে ছুটেছি। আর সব সময় বিশ্বাস করতাম, আমাকে দিয়ে হবে। এই বিশ্বাসই হয়তো আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।’ তবে এখানেই থামতে চান না তিনি। পড়াশোনা কাজে লাগাতে চান দেশের কল্যাণে। ফৌজিয়া বলেন, ‘আমি চাই, এখান থেকে যা পড়ে যাচ্ছি, তা যেন দেশের জন্য কাজে লাগাতে পারি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এ বিষয়ে পিএইচডি করার ইচ্ছা আছে।’