বোন শ্রেয়ার জন্মদিনে মা সারা যাকের, বাবা আলী যাকেরের সঙ্গে ইরেশ, ১৯৮৯
বোন শ্রেয়ার জন্মদিনে মা সারা যাকের, বাবা আলী যাকেরের সঙ্গে ইরেশ, ১৯৮৯

সালামি জমিয়ে একটা ক্রিকেট ব্যাট কিনেছিলাম

অদ্ভুতভাবে শৈশবের ঈদ নিয়ে লিখতে বসে প্রথম যে কথাটা মাথায় এল সেটা হলো, ফ্রুট কোলা কাপ। আশির দশকের মাঝামাঝি এক ঈদে বাজারে এই নামের একটা আইসক্রিম এসেছিল। সেই ঈদে আমি আর আমার বন্ধুরা আমাদের ঈদির সিংহভাগ খরচ করেছিলাম এই আইসক্রিমের পেছনে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে তখন এত অপশন ছিল না। নতুন একটা আইসক্রিমই ছিল আমাদের জন্য বিশাল ব্যাপার।

ছোটবেলায় ঈদ যে খুব বৈচিত্র্যময় ছিল, সে রকম নয়। বেশির ভাগ ঈদের রুটিন ছিল মোটামুটি এক রকম। সকালে বাবার (আলী যাকের) মামার সঙ্গে দেখা করা। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আমলের বিখ্যাত ফুটবলার। তাঁকে সবাই জানত ছোট রশিদ নামে। আমি ডাকতাম—ফুটবল দাদা। রাইট উইং দিয়ে ক্রস করার গল্প তাঁকে দিয়ে বারবার বলাতাম।

বোনের সঙ্গে ঈদে তোলা ছবি, ১৯৮৬

এরপর যেতাম মগবাজারে বাবার সবচেয়ে বড় খালাতো বোন, আমার বড় ফুফুর বাসায়। যদিও বাসাটা ছিল পাঁচতলা, আমরা ডাকতাম চারতলার বাসা। খুব সম্ভবত বাসাটা যখন বানানো হয়, আমার জন্মের বহু বছর আগে, তখন চারতলা ছিল। পরে একতলা সংযোজন করা হয়। চারতলায় বাবার দিকের অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। তাঁদের মধ্যে আমার এক দূরসম্পর্কের চাচা ছিলেন, যাঁকে আমি ডাকতাম ‘টারজান’। কেন ডাকতাম, এখন আর মনে পড়ছে না। টারজানের দুটো দাঁত ভাঙা ছিল। আমি বহু বছর বিশ্বাস করেছি যে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁর দাঁতের এই অবস্থা হয়েছে। চারতলার বাসার এক বিশাল আকর্ষণ ছিল একটি বাথরুমে থাকা বিশাল বিশাল টিকটিকি। ছোট ছিলাম বলে সেগুলো দেখে বড় মনে হতো কি না জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় এত বিশাল টিকটিকি বাংলাদেশে আর কখনো দেখিনি। বড় ফুফুর পরিবারের মানুষের মধ্যে একটা অসাধারণ আদর ছিল। ফুফু নিজে ছিলেন আমাদের পরিবারের কর্ণধার। বাবা অনেক আগেই আমার দাদা–দাদিকে হারিয়েছিলেন। তাঁদের অনুপস্থিতি বড় ফুফু আর ফুফা আজীবন পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। অদ্ভুত মায়া ছিল তাঁদের মাঝে।

বড় ফুফুর বাড়ি থেকে আমরা যেতাম ইস্কাটনে আমার নানির বাড়িতে। যদিও আমার বড় আব্বা, অর্থাৎ আমার নানির বাবা, তখনো জীবিত ছিলেন, বাসাটাকে আমি নানির বাড়ি হিসেবেই মনে করতাম। আমার নানির দিকে সবাই, অন্তত যাঁরা দেশে থাকতেন, ইস্কাটনে মিলিত হতেন দুপুরে খাওয়ার জন্য। সময়টা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ছিল ঈদির কারণে। শুরু হতো বড় আব্বার কাছ থেকে। তিনি আমাদের পাঁচ টাকা ঈদি দিতেন। পরে আরও অনেকেই দিতেন। এ রকম তিন ঈদে টাকা জমিয়ে আমি একটা ‘সানরিজেস’–এর ক্রিকেট ব্যাট কিনেছিলাম। কেনার কয়েক মাস পরেই সেটা চুরি হয়ে যায়। আশা করি, ব্যাটটা যে চুরি করেছিল, সে আমার চেয়ে অনেক ভালো ক্রিকেট খেলত।

বাবার সঙ্গে আনন্দঘন এক মুহূর্ত

নানির বাসার একটা বিশাল আকর্ষণ ছিল সেমাই। সেমাই আমার মায়ের দিকের পরিবারের একটা বিশেষত্ব। ‘চারগুণই’ নামে একটা সেমাই ছিল। ডিম দিয়ে রান্না হতো। সেমাইয়ের পরিমাণে চার গুণ বেশি ঘি আর চিনি দেওয়া হতো। এই অসাধারণ সুস্বাদু ও ভয়ংকর! সেমাইয়ের একটা আরও অসাধারণ ‘আটগুণই’ সংস্করণ ছিল। ‘আটগুণই’ নাম কেন ছিল, সেটা মনে হয় আর খুলে বলতে হবে না। একবার এই ‘চারগুণই’ আমি একাই এক গামলা খেয়েছিলাম। সেই যে মোটা হলাম, এখনো শুকাতে পারিনি।

নানির বাসার আদর ছিল একটু অন্য রকম। আমার ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে নানির বাসায়। সত্যি বলতে কি, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে আমি আর আমার বোন প্রথম সেই বাসাতেই উঠি। সুতরাং সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ। দুষ্টুমি বেশি করতাম, বকাও বেশি খেতাম। ছোটবেলায় আমার ব্যক্তিগত ফেবারিট ছিল জমু মামা। জমু মামা আমার মায়ের সবচেয়ে ছোট খালাতো ভাই। আমার চেয়ে মাত্র আট বছরের বড়। যেমন আদর করতেন, তেমন অত্যাচার করতেন। আমার জীবনে একমাত্র মানুষ তিনি, যাঁর কাছে আমি গাট্টা খেয়েছি। জমু মামার ঘরে দুইটা দরজা ছিল। সেগুলোকে গোলপোস্ট বানিয়ে আমরা একক ঈদ ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতাম। জমু মামা আমার চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও আমি এক বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। জমু মামাই আমাকে জীবনভর লিভারপুলের সমর্থক বানিয়েছিল। কয়েক বছর আগে লিভারপুল যখন ৩০ বছর পর আবার চ্যাম্পিয়ন হলো, সেই জমু মামাকেই আমি প্রথম ফোন করি, আমেরিকায়।

তখন ঈদের সন্ধ্যাগুলো কাটত বাসায়, টিভির সামনে। বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আর ঈদের নাটক ছিল বিশেষ আকর্ষণ। একবার ঈদের নাটক ছিল হুমায়ূন (আহমেদ) চাচার লেখা একদিন হঠাৎ। সে নাটকে অন্য আরও অনেকের মধ্যে বাবাও অভিনয় করেছিল। নাটকের একপর্যায়ে বাবার অভিনীত চরিত্র খাট ভেঙে পড়ে যায়। সবাই দৃশ্যটি দেখে অনেক মজা পেয়েছিল, কিন্তু আমি পাইনি। টেলিভিশনের পর্দাতেও বাবাকে অপদস্থ দেখতে ছোটবেলায় ভালো লাগত না। এ ছাড়া মাথায় ছিল যে স্কুলে গেলে বন্ধুরা এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।

ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে যাওয়ার এখন বেশ চল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় সে রকম ছিল না। আমরা শুধু একবারই কক্সবাজারে গিয়েছিলাম ঈদের সময়। ঈদ আর সমুদ্রের মতো দুইটা অসাধারণ জিনিস যে একসঙ্গে ঘটতে পারে, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমার বোনের তখন এক বছর বয়স। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সে বাবার কোলে হিসু করে দিয়েছিল। লেগে গেল তাড়াহুড়া। সে এক বিশাল ঘটনা।

সময়টা ছিল সহজ ও আনন্দের। এখনো হয়তো আমার কন্যা, যার বয়স চার, তার কাছে সময়টাকে সহজ আর আনন্দের বলে মনে হয়। আমরা হয়তো বয়সের সঙ্গে জীবনকে আরও জটিল করে দেখি। অতীতকেও জটিল করে দেখি। তবে ঈদের স্মৃতিগুলো জটিল করে দেখতে ইচ্ছা করে না। যাদের কথা বললাম, তারা অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই। থাকুক না সোনালি আলোমাখা ঈদের স্মৃতিগুলো এক কোনায়। যারা আছে, তাদের সঙ্গে তৈরি হোক নতুন নতুন অনেক অসাধারণ ঈদের স্মৃতি আমাদের সবার। আগাম ঈদ মোবারক সবাইকে। 

লেখাটি বর্ণিল ঈদ ২০২৪ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত