আজিজুল যেভাবে ‘বিমান মানিক’ হলেন

বুয়েটে নৌযান ও নৌযন্ত্রকৌশল নিয়ে পড়েছেন আজিজুল ইসলাম। কিন্তু সাগর নয়, আকাশই তাঁকে টানত বেশি। কীভাবে একটা অ্যারোস্পেস কোম্পানি চালু করলেন তিনি? নাসার একটি প্রকল্পে পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে ডাক পাওয়ার পেছনের গল্পটাই–বা কী? আর বন্ধুরাই–বা কেন তাঁকে ‘বিমান মানিক’ বলে ডাকেন? শুনেছেন তানভীর রহমান

ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতি ভালোবাসতেন আজিজুল ইসলাম। আর ভালোবাসতেন উড়োজাহাজ। বাবার রেলস্টেশনের চাকরির সুবাদে রেলের বড় বড় যন্ত্রাংশ ছিল তাঁর খেলনা। স্কুলে পড়ার সময় হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই বানিয়ে ফেলেছেন বাস, লঞ্চ। বিমান তৈরির চেষ্টাও তখন থেকেই চলছিল।

ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়বেন। কিন্তু জ্বরাক্রান্ত হয়ে পরীক্ষাটা মনমতো দিতে পারেননি। তাই সুযোগ হয় নৌযান ও নৌযন্ত্রকৌশল বিভাগে। আঁকিবুঁকি ভালো লাগত। ভেবেছিলেন, এই বিষয়ের সঙ্গে হয়তো আঁকাআঁকির সম্পর্ক আছে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর বুঝলেন, ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। অতএব ক্লাসের পড়ার বদলে ফুটবল খেলা, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আর টিউশনিই দখল করে নিল আজিজুলের সারা বেলা।

ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং করতে পারে, এমন একটা ছোট বিমান বানান আজিজুল

বিমান তৈরির ঝোঁক

২০০৩ সালে বুয়েটে ‘হানড্রেড ইয়ারস অব ফ্লাইট’ নামে একটা প্রদর্শনী হয়। তিন দিন ধরে চলা এ আয়োজনে বিমানের রেপ্লিকা, মডেল, নানা কিছু স্থান পেয়েছিল। প্রদর্শনী ঘুরতে গিয়েই পুরোনো ভূতটা আবার মাথায় চেপে বসে। আজিজুল সিদ্ধান্ত নেন, বায়ুগতিবিদ্যা (অ্যারোডাইনামিকস) নিয়ে পড়বেন। মৌলিক বিষয়গুলো আগেই জানা ছিল। বুয়েটের গ্রন্থাগার থেকে এই বিষয়ক বইয়ের খোঁজ পেলেন। ফটোকপি করে সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি।

২০০৪ সালে আজিজুল ইসলাম নিজেই একটা বিমান বানিয়ে ফেলেন। যদিও প্রথমদিকে এটি খুব বেশি উড়তে পারত না। ২-৩ বা ৪ ফুট উচ্চতায় ওঠার পরে নেমে যেত। ২০০৫ সালে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’–এর খোঁজ পান। সেই বড় ভাই-ই একপ্রকার জোর করে আজিজুলকে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করান। সেখানে তাঁর তৈরি বিমান ব্যাপক সাড়া ফেলে। ২০০৯-২০১০ সালে ড্রোন, পানির নিচে চলতে সক্ষম রোবটও তৈরি করেন তিনি।

আজিজুল ইসলামের ডাকনাম মানিক। তত দিনে তাঁর বিমানপ্রীতির কথা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে। বন্ধু, সিনিয়ররা আজিজুলকে ‘বিমান মানিক’ নামে ডাকতে শুরু করেন। এই বিমানপ্রীতির জন্য ক্যাম্পাসের সবাই তাঁকে আলাদা চোখে দেখতেন, ভালোও বাসতেন। একবার যেমন জন্মদিনে টিউশনি থেকে ফিরে দেখেন, বড় ভাই-জুনিয়ররা মিলে ঘরে বিমানের একটা রেপ্লিকা ঝুলিয়ে রেখেছেন।

নানা আবিষ্কার

২০১৯ সালে ঈগলএক্স নামের একটি ড্রোনভিত্তিক ডিজিটাল ম্যাপিং প্রতিষ্ঠান চালু করেন আজিজুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল ড্রোনের সাহায্যে ছবি সংগ্রহ করে ডিজিটাল উপায়ে জরিপ পরিচালনা করা। এ পদ্ধতিতে বিআইডব্লিউটিএর জন্য ঢাকা শহরের একাধিক নদীর ওপর জরিপ কাজ চালিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তখন ড্রোনের সাহায্যে লার্ভা শনাক্তকরণের কাজেও যুক্ত ছিলেন আজিজুল।

ঈগলএক্সের কাজে ব্যবহৃত ড্রোনগুলো মূলত বাজার থেকেই কিনতে হতো, ছিল নানা সীমাবদ্ধতাও। তাই ২০২১ সালে আজিজুল নিজেই একটা অ্যারোস্পেস কোম্পানি দাঁড় করান। নাম স্কাইওয়ার্পস অ্যারোনটিকস লিমিটেড। আজিজুল বলছিলেন, ‘ড্রোনের সুবিধা হলো, এটা এক জায়গায় স্থির থেকে উঠতে–নামতে পারে। ভাবছিলাম, এই সুবিধা যদি বিমানে যুক্ত করা যায়, তাহলে রানওয়ের দরকার হবে না।’ তখন ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং করতে পারে, এমন একটা ছোট বিমান বানান তিনি। সঙ্গে যুক্ত করে দেন ক্যামেরা। এভাবেই তাঁর হাত ধরে তৈরি হয় ভিন্ন ধরনের ড্রোন।

নাসার সঙ্গে কাজ

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার লক্ষ্য হলো, ২০৫০ সালের মধ্যে এমন উড়ালযান তৈরি করা, যাতে কোনো কার্বন নিঃসরণ হবে না। এই প্রকল্পে ৮ মিলিয়ন ডলারের বাজেট অনুমোদন দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। টেনেসি টেক ইউনিভার্সিটির প্রকৌশলীরা এই গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে আজিজুল ইসলামও গবেষক দলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকে সেই যে বিমানের প্রতি আগ্রহ, সেই আগ্রহই তাঁকে এত দূর নিয়ে গেছে। আজিজুল বলেন, ‘অ্যারোস্পেস ভেহিকেল নিয়ে নাসার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে। এই বিষয়ে আরও বড় পরিসরে ভূমিকা রাখতে চাই।’