আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার গ্রিক পুরাণ থেকে আমাদের প্রায়ই শোনান দাফনির গল্প। দাফনি এক ভয়ংকর রূপবতী নারী ছিলেন। নদীর দেবতা পিনিয়াস ছিলেন তাঁর বাবা। দাফনি সারাক্ষণ ছুটে বেড়াতেন। একদণ্ড স্থির থাকতেন না। সবাই তাঁর প্রেমে পড়ত। কিন্তু তিনি ধরা দিতেন না।
তিনি বাবাকে বলে রেখেছেন, আমি বিয়ে করব না। দেবতা অ্যাপোলো দাফনিকে দেখামাত্র প্রেমে পড়লেন। তিনি ছুটতে লাগলেন দাফনির পেছনে। দাফনিই দৌড়াতে শুরু করলেন। অ্যাপোলো মিনতি করতে লাগলেন, আমি তোমার শত্রু নই, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি, আমি দেবতা অ্যাপোলো, তুমি দাঁড়াও। কিন্তু দাফনি তো পণ করে রেখেছেন যে কাউকে ধরা দেবেন না।
তিনি ছুটে গেলেন নদীর কাছে, গিয়ে তাঁর দেবতা-বাবাকে বললেন, আমাকে উদ্ধার করো, আমি ধরা দেব না। নদীদেবতা তখন দাফনিকে দাঁড় করালেন। তাঁর শরীরে গাছের বাকল হলো। পায়ে শিকড় গজাল। হাত–মাথাজুড়ে ডালপালা আর পাতা গজাতে লাগল। তিনি একটা লরেলগাছে পরিণত হলেন। অ্যাপোলো তাঁর কাছে এলেন। বললেন, দাফনি, তবু তোমাকেই আমি ভালোবাসব। এত দিন শুধু তুমি ছুটে বেড়িয়েছ, আজ তুমি স্থির হয়েছ। এখন তুমি কিছু দিতে পারবে। কত সুন্দর তোমার সবুজ পাতা। আমি বর দিচ্ছি, তোমার পাতা চিরসবুজ থাকবে। তোমার বাকল দিয়ে আমি মুকুট বানাব। তোমার পাতা খেলা শেষে বিজয়ীরা মাথায় ধারণ করবে। তোমার ডাল দিয়ে আমি ধনুক বানাব।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, সারাক্ষণ ছুটে বেড়াতে হয় না। একটু শান্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়। একটু ধীরস্থির হতে হয়।
আমাদের এই সময়ে আমরা কোনো কিছুতে মন বসাতে পারি না। সারাক্ষণ অস্থিরতা কাজ করে আমাদের সঙ্গে। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী দেখতে বসলে আমাদের মনে হয়, আরে, এ তো ভীষণ স্লো। কিন্তু যদি মনটা একটু শান্ত রাখি, পুরো ছবিটা দেখি, কী যে ভালো লাগায় আমাদের সমস্ত সত্তা ভরে ওঠে।
এই সময়ে তাই ভীষণ দরকার দাবা খেলাকে জনপ্রিয় করা। দাবা যে শুধু আমাদের মনকে শান্ত, চিত্তকে প্রফুল্ল করবে, আমাদের মনঃসংযোগ ঘটাবে, তা–ই নয়, দাবা আমাদের আইকিউ বাড়াতেও ভীষণ সাহায্য করে। এ নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে। দাবা কী করে মানুষের বুদ্ধাঙ্ক বা আইকিউ বাড়াতে সাহায্য করে, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। মানুষের বয়স হলে মানুষ যে স্মৃতিশক্তির দুর্বলতায় ভোগে, ডিমেনশিয়ায় (স্মৃতিভ্রংশ) ভোগে, তা থেকে বাঁচার একটা উপায়—দাবা খেলা। যারা দাবা খেলে, তারা যারা দাবা খেলে না, তাদের চেয়ে বুদ্ধিমান হয়—গবেষণা এমনটাই বলছে।
কাজেই দাবা খেলো, বুদ্ধি বাড়াও। বাংলাদেশে আমরা শারীরিক আকারে অনেক লম্বা–চওড়া নই। আমাদের গড় স্বাস্থ্যও ভালো নয়। তার ওপর আছে নানা দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, পানি-বাতাস দূষিত। এ অবস্থায় আমরা ভালো করতে পারব বুদ্ধির খেলায়। আর ভালো করতে পারব সৃজনশীলতায়, গানে, বাজনায়, ছবি আঁকায়। এ জন্য চর্চা করতে হবে।
দাবা খেলা হতে পারে আমাদের আত্মরক্ষার এবং বিজয় ছিনিয়ে আনার সবচেয়ে সহজ আর বড় হাতিয়ার। দাবা খেলতে কোনো খরচ লাগে না। মাঠ লাগে না, ঘাট লাগে না। খেলতে শুরু করে দিলেই হলো। এখন তো কম্পিউটারে দাবা খেললে মানুষসঙ্গীও লাগে না। আমাদের শিশু-কিশোরদের সবার উচিত দাবা খেলা শেখা, দাবা খেলার চর্চা করা। তাহলে আমরা একটা বুদ্ধিমান প্রজন্ম পাব। একই সঙ্গে খেলায় বা যুদ্ধে জেতার আনন্দ পাব। হেরে গেলে হারাটাও শিখব। খেলা তো কেবল জেতার জন্য নয়। পরাজয় মেনে নিতে শেখার জন্যও।
পৃথিবীতে দাবার ইতিহাস অতিপ্রাচীন। কেউ মনে করেন, এটা খ্রিষ্টপূর্ব জমানার খেলা। সবচেয়ে প্রচলিত মত হলো, দাবা এই উপমহাদেশে আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতাতেও দাবা খেলা হতো বলে মনে করা হয়। তবে আজ থেকে ১ হাজার ৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে চতুরঙ্গ বা শতরঞ্জি নামে দাবা খেলা হয়েছে।
বাংলাদেশে দাবার ইতিহাসের সঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেনের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাঁকে বলা হয় ‘দাবাগুরু’। তিনিই ১৯৭৪ সালে দাবা ফেডারেশন গড়ে উঠতে সাহায্য করেন। দাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও দাবা খেলতেন। বাংলাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ। এখন বাংলাদেশে পাঁচজন গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন। তাঁরা হলেন নিয়াজ মোর্শেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব আর এনামুল হোসেন রাজীব। আশির দশকে নিয়াজ মোর্শেদ যখন গ্র্যান্ডমাস্টার হন, তিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। এখন ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টার ৭৬ জন। আমাদের ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের অপেক্ষা ফুরোচ্ছে না। এ অবস্থায় দাবাকে জনপ্রিয় করতে হবে। ঘরে ঘরে দাবা খেলার প্রচলন চাই। তার সঙ্গে দরকার অবকাঠামো। সংগঠন। নেতৃত্ব। কর্মসূচি।
আশার কথা হলো, দেশে শুরু হয়েছে ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’। গত বছরের ২১ আগস্ট গাজীপুর থেকে শুরু হয়েছিল দেশব্যাপী এই স্কুলভিত্তিক দলগত দাবা প্রতিযোগিতাটি। আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পন্ন হয়েছে এই জাতীয় প্রতিযোগিতার প্রথম সিজন। চ্যাম্পিয়ন দলের দাবাড়ুরা পাবে মোট ১০ লাখ টাকা পুরস্কার। প্রথম রানার্সআপ দলের দাবাড়ুরা পাঁচ লাখ এবং দ্বিতীয় রানার্সআপ দলের দাবাড়ুরা পাবে মোট তিন লাখ টাকা পুরস্কার। চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যদের বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলেও আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
স্কুলের ছেলেমেয়েরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। দলীয় প্রতিযোগিতা বলে স্কুলে স্কুলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতে এই প্রতিযোগিতা থেকে আমরা নানা ধরনের উপকার পাব। এক. দাবা নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হবে। আমাদের সন্তানেরা বুদ্ধিমান, ধীশক্তিসম্পন্ন, সুন্দর চিন্তার মানুষ হবে। দুই. আমরা এদের মধ্য থেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবাড়ু পাব। দেশের জন্য তারা সুনাম বয়ে আনবে।
বুদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের সম্পর্ক আছে। সুষম খাদ্য বুদ্ধির জন্য দরকার। এটা আমি সব সময় প্রচার করি আমার সিরিজ গল্প ও কমিকস গুড্ডুবুড়ার মাধ্যমে। গুড্ডুবুড়া বোকা থাকে। কারণ, সে খায় না। নানা বোকামো করে। তারপর যখন সে খায় আর খেলাধুলা শুরু করে, সে হয়ে ওঠে বুদ্ধিমান। দুধ হলো আদর্শ খাদ্য। এতে সব ধরনের পুষ্টিগুণ, মিনারেল আর ভিটামিন আছে। কাজেই মার্কস মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল ব্র্যান্ডের সঙ্গে দাবাটা যাচ্ছে ভালো।