আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য

কাল্পনিক কোনো মামলায় বাদী-বিবাদীর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনাকেই সহজ ভাষায় বলা হয় মুটকোর্ট বা মুটিং। হাতে-কলমে শিক্ষা নেওয়ার জন্য আইনের শিক্ষার্থীদের কাছে মুটিং বেশ জনপ্রিয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মুটকোর্ট প্রতিযোগিতায় সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য দুটি সাফল্য পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়েছেন এইচ এম ফজলে রাব্বী

জেসাপ ইন্টারন্যাশনাল ল মুটকোর্ট কম্পিটিশন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে ছিলেন ঐশী রহমান, রাফিদ আজাদ, হেলাল মোর্শেদ ও মারুফ হাসান

ফিলিপ সি জেসাপ ইন্টারন্যাশনাল ল মুটকোর্ট কম্পিটিশনকে বলা হয় মুটকোর্টের সবচেয়ে সম্মানজনক প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক এই প্রতিযোগিতা মুটিংয়ের ‘বিশ্বকাপ’ হিসেবেও পরিচিত। ১৯৬০ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় ২০১৭ সাল থেকে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ।

এ বছর দেশের ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আয়োজিত বাংলাদেশ রাউন্ডে চতুর্থবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত ৬৪তম জেসাপ মুটকোর্ট প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক রাউন্ডে অংশ নেয় সারা বিশ্বের ৫৮০টি দল। এবারের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমবারের মতো একমাত্র বাংলাদেশি দল হিসেবে সেরা ৪৮-এ পৌঁছায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া মেমোরিয়াল (অ্যাপ্লিক্যান্ট) র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম স্থান অর্জন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে ছিলেন ঐশী রহমান, রাফিদ আজাদ, হেলাল মোর্শেদ ও মারুফ হাসান। ঐশী বলেন, ‘যেদিন রাতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে এবারের ফ্যাক্ট রিলিজ করা হয়, সেদিন থেকেই আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে এর আগে আমরা কখনো যেতে পারিনি।’ দলের আরেক সদস্য রাফিদ বলেন, ‘আমরা জানতাম যে এটার জন্য একদম শুরু থেকেই আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। এ জন্য আমরা এক দিনও নষ্ট করিনি, একদম প্রথম থেকেই নিয়মিত প্রস্তুতি নিয়েছি এবং প্রতিযোগিতার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছি।’

আয়োজনের কল্যাণে ভিনদেশি অনেক বন্ধুও জুটে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতই তাঁদের কথা হচ্ছে। এবারের আয়োজনের অন্যতম বিশেষত্ব ছিল ‘গো ন্যাশনাল ড্রেস বল’। যেখানে সবাই যার যার দেশের জাতীয় পোশাক পরেছিল। ঐশী বলেন, ‘আমি পরেছিলাম শাড়ি। টিমমেটরা পাঞ্জাবি। শাড়ি দেখে অন্যান্য দেশের অনেকেই অবাক হচ্ছিল, প্রশংসা করেছিল।’ সামনে আরও ভালো ফল করার প্রত্যয় এই হবু আইনজীবীদের।

মনরো ই প্রাইস মিডিয়া ল মুটকোর্ট কম্পিটিশন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুটকোর্ট সোসাইটির অধীনে এই দলের সদস্যরা প্রত্যেকেই আগে ক্যাম্পাসের হয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন

মুটিংয়ের জগতে আরেক অভিজাত প্রতিযোগিতা মনরো ই প্রাইস মিডিয়া ল মুটকোর্ট কম্পিটিশন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আইনের ওপর এটিই সবচেয়ে বড় আয়োজন। সারা বিশ্বকে দেশভিত্তিক সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রথমে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এবারের প্রতিযোগিতায় ৫২টি দেশের ৭৮টি দল অংশ নেয়। এশিয়া থেকে চারটি দল সুযোগ পেয়েছিল। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ভারত থেকে দুটি ও পাকিস্তান থেকে একটি দল অংশ নেয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫তম স্থান অর্জন করে।

মনরো ই প্রাইস মিডিয়া ল মুটকোর্ট প্রতিযোগিতার আয়োজক বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদভুক্ত বোনাভ্যারো ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটস। এটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আইন, বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর শীর্ষ প্রতিযোগিতা, যা গ্র্যান্ড স্লাম হিসেবে স্বীকৃত। এবারের প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে চারজন অংশ নেন; রাফি ইবনে মাসুদ, রেজওয়ান খায়ের, কাজী রাকিব হোসাইন ও রিজওয়ানা রশিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুটকোর্ট সোসাইটির অধীনে এই দলের সদস্যরা প্রত্যেকেই আগে ক্যাম্পাসের হয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে আগেভাগেই দল গঠন করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতার ফ্যাক্ট রিলিজের পরই শুরু হয় পুরোদমে প্রস্তুতি। কিন্তু বাদ সাধে আইন বিভাগের একাডেমিক ক্যালেন্ডার। একদিকে ভালো কিছু করার প্রত্যয়, অন্যদিকে ফাইনাল পরীক্ষা। তারপরও সময় মিলিয়েই প্রস্তুতি নিতে থাকেন তাঁরা।

দলের সদস্য রাফি বলেন, ‘মূল পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছিল নাইজেরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের দল। আমাদের প্রথম রাউন্ড ছিল নাইজেরিয়ার সঙ্গে। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই দল, কেউ কারও ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে পারছিলাম না। তবু শেষমেশ সেই ম্যাচে আমরা জয়ী হই। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।’

২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রাইস মুটে এ বছরই বাংলাদেশের ফল ছিল সবচেয়ে ভালো। তবে রাফি ও তাঁর দলের সদস্যরা আশা করেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মুটিং আরও পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। আসবে আরও অর্জন।