‘প্রেত’ নাটকের দৃশ্যে আহমেদ রুবেল ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভৌতিক উপন্যাস ‘প্রেত’–এর প্রচ্ছদ
‘প্রেত’ নাটকের দৃশ্যে আহমেদ রুবেল ও 
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভৌতিক উপন্যাস ‘প্রেত’–এর প্রচ্ছদ

আহমেদ রুবেল, আমরা যাঁকে ভালোবেসেছি ‘প্রেত’ নাটকের রুমী হিসেবে

বয়সটা তখন এমন, ঘরে হাফপ্যান্ট বা থ্রি-কোয়ার্টার পরে থাকা গেলেও বাইরে বেরোনোর আগে ওই হাফপ্যান্টের ওপর ফুলপ্যান্ট পরতেই হয়। নইলে যেন কেমন কেমন লাগে! আর সময়টা তখন এমন, মুগ্ধ হওয়ার মতো একটা বই পড়ে বাইরে হাঁটতে গেলেও যেন কেমন কেমন লাগে! মনে হয়, আরে, আমিই তো সেই বইয়ের নায়ক। তেমনই এক সময়ে পড়েছিলাম মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভৌতিক উপন্যাস ‘প্রেত’। কাজেই খুব স্বাভাবিকভাবে ‘প্রেত’পাঠ–পরবর্তী কোনো কোনো সন্ধ্যায় ফুলপ্যান্ট পরে বাইরে বেরোলে প্রায়ই মনে হতো, পেছন থেকে একটা হালকা নীল রঙের গাড়ি এসে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়েছে গা ঘেঁষে। গাড়ি থেকে মাথা বের করে একটা মেয়ে উচ্চ কণ্ঠে ডাকছে, ‘রুমী, রুমী!’

‘প্রেত’ নাটেকর শুরুর দৃশ্য

২০০১ সালের কোনো একদিন শোনা গেল, সেই রুমী, অর্থাৎ ‘প্রেত’ উপন্যাস নিয়ে নাটক হচ্ছে! নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর খবর। একুশে টেলিভিশনে টিজার দেখে খানিকটা ধন্দেও পড়ে গেলাম। টিজারে দেখাচ্ছে, এক তরুণকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে আজদাহা সাপ, তরুণের চোখেমুখে আতঙ্ক, অস্বস্তি, নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা। ধন্দটা এখানেই। কই, বইয়ে তো এমন কোনো দৃশ্যকল্প নেই! নাটকে আবার সাপ কেন? উপন্যাসটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে না তো?

এত সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাশে রেখে তুমুল আগ্রহ নিয়ে দেখতে বসলাম আহীর আলম পরিচালিত ‘প্রেত’। আর পয়লা দৃশ্যেই ওই সাপ জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। তরুণের অস্বস্তি আমাদের মধ্যেও যখন সংক্রমিত, ঠিক তখনই শোনা গেল ফজরের আজান। আজানের ধ্বনিতে দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে তরুণ মেঝেতে পাতা শয্যা ছেড়ে ঘরের জানালা খুলে দিলেন, ভোরের আলোয় স্পষ্ট হলো তাঁর মুখ। দুঃস্বপ্ন কেটে যাওয়ার পুলকে হয়তো তাঁর মুখে খেলে গেল একচিলতে হাসি। আর ঠিক তখন থেকে, নাটকের ঠিক সেই ভোরবেলার দৃশ্য থেকে রুমী কিংবা আহমেদ রুবেলকে আমরা ভালোবেসে ফেললাম। আশ্বস্ত হলাম, হ্যাঁ, এ-ই তো ‘প্রেত’-এর রুমী!

সেকেলে সিঁথি কাটছেন রুমী কিংবা আহমেদ রুবেল

নাটকের পরবর্তী দৃশ্যগুলোতেও আহমেদ রুবেল ক্রমে ‘রুমী’ হয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর মেস রুমের নিঃসঙ্গ দেয়ালের পোস্টারে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। রুমী গোসল শেষে গায়ে শার্ট চাপানোর আগে শুঁকে দেখছেন তাতে ঘামের দুর্গন্ধ কতটা সহনীয়। খরখরে চুলগুলো তিনি বাগে আনার চেষ্টা করছেন তেল মেখে। আবার ওই তেল মাখা চুলে কাটছেন সেকেলে সিঁথি! মেস থেকে বেরোনোর সময় মেসওয়ালা তাঁকে ভাড়ার টাকার কথা মনে করিয়ে দিতেই প্রত্যুত্তরে ভেসে আসে সলজ্জ ভরাট কণ্ঠ। ব্যস, ততক্ষণে আমরা ‘হুকড’, মানে বড়শি গিলে ফেলেছি, রুমী ওরফে আহমেদ রুবেল আমাদের দখল নিয়ে ফেলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়েও গ্রাম থেকে উঠে আসা রুমী হিসেবে আহমেদ রুবেল অনবদ্য। যেন চিড়িয়াখানার ওই লাজুক হরিণশাবক, যে মানুষের এগিয়ে দেওয়া কাঁঠালপাতার দিকে এগিয়ে যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত, অথচ তার সজল চোখে রাজ্যের কৌতূহল। এই কৌতূহল আরও চাগিয়ে দিলেন কিবরিয়া ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খ্যাপাটে অধ্যাপকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমাদের আরেক বিস্ময় হুমায়ুন ফরীদি।

‘প্রেত’ নাটকে আহমেদ রুবেলের সহশিল্পী হুমায়ুন ফরীদি

আর এখানেই হুমায়ুন ফরীদির রোদের আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আহমেদ রুবেল ফুটে উঠেছিলেন সূর্যমুখীর মতো। টেলিভিশনে নবীন মুখ হিসেবে যাকে বলে ‘একের “ক”’। হুবহু মনে না থাকলেও স্বয়ং মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, আহমেদ রুবেল আর দশজনের মতো নন। অনেকেই ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে মুখ শক্ত করে সংলাপ আওড়ে যান, সেখানে আহমেদ রুবেল সাবলীল, প্রাণবন্ত। তাঁর অভিনয় দেখে মনে হয় না যে অভিনয় করছেন।

১১ পর্বের ‘প্রেত’-এ বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে রুমী চরিত্রটা। আহমেদ রুবেলও দেখিয়েছেন নিজের হিম্মত। কিবরিয়া ভাইয়ের পরামর্শে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে পড়ে নতুন দিগন্তের খোঁজ পাওয়া, নতুন প্রেমে পড়া, তথাকথিত শহুরে স্মার্টদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো কিংবা মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলার মতো সাংঘাতিক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার অভিনয় করেছেন বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে।

রুমী যখন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী

আর কালো জাদুকরদের কবলে পড়ার পর কিংবা লুসিফার ভর করার পর রুমীর জীবনের খোলনলচে যেভাবে বদলে যায়, আহমেদ রুবেল তা ধারণ করেছেন আমাদের কল্পনার নকশা অনুযায়ী।

‘প্রেত’ নাটকের আহমেদ রুবেলের সহশিল্পী কুমকুম হাসান

এই ফাঁকে নির্মাতা আহীর আলমের কথাও স্মরণ করি গভীর ভালোবাসার সঙ্গে। বিশ শতকের নব্বইয়ের শেষ ও একুশ শতকের শুরুতে একুশে টেলিভিশন আমাদের যে আধুনিকতার তাজা হাওয়া এনে দিয়েছিল, আহীর আলম ওই হাওয়া বদলকারীদের একজন। অকালেই প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আজ চলে গেলেন তাঁরই সহচর আহমেদ রুবেল। আমাদের কৈশোরে রুমী হিসেবে তিনি যে মুগ্ধতার ছাপ্পড়টা বুকে মেরে দিয়েছেন, তা আজও টাটকা। তাই আজ তাঁর নাম উচ্চারণের আগে বলি—আহ্! আহমেদ রুবেল!