সেনেগালের ফুটবল দলের অধিনায়ক কালিদু কুলিবালি। প্লেয়ারস ট্রিবিউনে লেখা তাঁর একটি নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত অংশ থাকল আজ।
এই লেখা পড়তে পড়তেই আপনি সেনেগালের ভক্ত হয়ে উঠবেন, কথা দিচ্ছি। এমনকি এবার বিশ্বকাপে সেনেগাল যদি আপনার প্রথম পছন্দ না-ও হয়ে থাকে, দ্বিতীয় পছন্দ হতেও আমাদের আপত্তি নেই।
প্রশ্ন করতে পারেন, কেন সেনেগাল?
আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের (আফকন) গল্প দিয়ে শুরু করি। ফাইনালে আমরা তখন মিশরের মুখোমুখি। অতিরিক্ত সময় শেষ। ক্যামেরুনের সেই স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম ২০০২ সালে।
ফুটবলারদের কাজই হলো ‘মুহূর্তে বাঁচা’। পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেনেগালের জন্য এটা ছিল বড় ট্রফি জেতার প্রথম সুযোগ। জানতাম, পুরো দেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার তাঁদের হৃদয় ভেঙেছে। মনে পড়ে, ২০১৮ বিশ্বকাপে ‘ফেয়ার প্লে’ টাইব্রেকারের কারণে কীভাবে আমরা বাদ পড়েছিলাম? ২০১৯ সালে আফকনের ফাইনালেও আমরা হেরেছি। ইতিহাস যেন কখনোই সেনেগালকে ভালোবাসেনি।
এমনকি ২০২২ সালের আফকনের সেমিফাইনালে মিশরের গোলকিপারের খেলা দেখে আমরা হোটেলে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলাম, ‘বাপরে! যেভাবেই হোক, আমাদের ৯০ মিনিটে খেলা শেষ করতে হবে। এই লোক তো সব বলই ঠেকিয়ে দেয়!’ সত্যিই! আমরা ঠিক করেছিলাম, যেভাবেই হোক, টাইব্রেকারে যাওয়া যাবে না।
অথচ হলো তা-ই। আমার মনে পড়ে গেল ২০০২ সালের বিশ্বকাপে তুরস্কের বিরুদ্ধে আমাদের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটির কথা, একই বছরে অনুষ্ঠিত আফকন ফাইনালে ক্যামেরুনের বিপক্ষে টাইব্রেকারের কথা। তখন আমি আমাদের ম্যানেজার অ্যালিউ সিসের দিকে তাকালাম। ২০২২ সালের সেই ম্যাচে মাঠে সে-ও ছিল। মনে মনে ভাবলাম, ‘হায়! এমনকি আমাদের বিগ বসও তো ক্যামেরুনের বিপক্ষে সেবার পেনাল্টি মিস করেছিল। আমরা বোধ হয় সত্যিই অভিশপ্ত।’
অ্যালিউ আমাদের বৃত্তাকারে দাঁড় করাল। এমন এক বক্তব্য দিল, যে আমাদের মনোভাবই পাল্টে গেল। আমরা সবাই জানি, অ্যালিউকে বর্ণনা করতে কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়। অনেকে যে পরিস্থিতিতে পা বাড়িয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে, অ্যালিউ মাথা পেতে দিতেও ভয় পায় না। টাইব্রেকারের কঠিন সময়ের আগে অ্যালিউ আমাদের বলল, ‘ভয় পেয়ো না’। বলল, ‘যাও, দেশের জন্য খেলাটা জিতে এসো। তোমরা ইতিহাস নতুন করে লিখতে পারো। কলম এখন তোমাদের হাতে।’
সেই বক্তব্যের পর আমাদের ভয় সব ভোজবাজির মতো দূর হয়ে গেল। তাঁকে বললাম, আমি প্রথমে যেতে চাই। ক্যাপ্টেন হিসেবে সব সময়ই আমি সব বিপদ নিজের কাঁধে নিতে চাইতাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অ্যালিউ সেদিন সবাইকে ডেকে বলল, ‘ঠিক আছে, কুলি সবার আগে যাবে। কিন্তু মনে রেখো, ওর ওপর কোনো চাপ নেই। চাপ সব আমার। কারণ, আমি ওকে বাছাই করেছি। জবাবদিহি আমি করব।’
অতএব আমি কিক করতে এগিয়ে গেলাম। এটা শুধুই একটা পেনাল্টি কিক ছিল না। এই লাথির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ২০ বছরের ইতিহাস।
আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু সেদিন কেন যেন মনে হচ্ছিল, জয় আমাদেরই। খেলার প্রথম ৫ মিনিটের মধ্যেই সাদিও একটা পেনাল্টি মিস করেছিল। শুনতে অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু সাদিওর মিসটা নয়, আমার চোখে পড়েছিল ওর অভিব্যক্তিটা। গোল করতে না পারলেও সঙ্গে সঙ্গেই ও এক হাত উঁচু করে আমাদের দেখিয়েছিল। চোখে ছিল আগুন, আর মুখে বলছিল, ‘চলো চলো। আজ ওদের দেখিয়ে দেব!’
ঠিক দুই ঘণ্টা পর ও যখন টাইব্রেকারে পেনাল্টি কিক নিতে এল, আমি জানতাম, এবার ও পারবে। কারণ, সেরারা কখনো দ্বিতীয় সুযোগ হাতছাড়া করে না।
সাদিও শট নিল, গোল হলো। আনন্দে আমরা সবাই ছুটতে শুরু করলাম। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর হয় না।
কোভিডের বাধ্যবাধকতার জন্য বলা হয়েছিল কাপ নিতে আমি একাই মঞ্চে যেতে পারব, আমার সতীর্থরা যাবে না। কিন্তু আমি রাজি হইনি। বলেছিলাম, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমি ট্রফিটা উঁচু করে ধরতে চাই। মনে আছে, আমি সবার আগে কাপটা অ্যালিউর হাতে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ, ২০ বছর আগে তাঁর হাত দিয়েই তো যাত্রাটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে বলেছিল, ‘থাক, আমার দেখাতেই আনন্দ।’
বিমানে করে যখন একটা ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরবেন, আপনার কল্পনায় অনেক ছবিই আসবে। কিন্তু একটা বাবলের ভেতর থাকলে কখনোই সত্যিকার চিত্রটা আপনাকে স্পর্শ করবে না। আপনি শুধু কিছু ছবি দেখবেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের বার্তা পাবেন। কিন্তু দেশের জন্য এই ট্রফির মূল্য কতখানি? যত যা-ই হোক, দিন শেষে তো ফুটবল স্রেফ একটা খেলা।
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে নামার পর সেদিন বুঝেছিলাম, খেলাটা শুধুই খেলা নয়। আমাদেরকে রাষ্ট্রপতি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাসে করে। সেখানে একটা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা। অনুষ্ঠানের সময় সেদিন পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। কারণ, যে পথ যেতে ২০ মিনিট সময় লাগে, সেই পথ পেরোতে সেদিন আমাদের লেগেছিল ৭ ঘণ্টা। হাজারো মানুষ আমাদের স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আমি এত ক্লান্ত ছিলাম, বাসে বসে একটু পরপর ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। আবার একটু পরপরই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল, কারণ, কেউ না কেউ চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছিল।
ধড়মড় করে উঠে বসে ভাবছিলাম, এটা কি একটা স্বপ্ন?
বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম, হাজারো মানুষ আমাদের নাম ধরে ডাকছে, পতাকা নাড়ছে, নাচছে। মনে হচ্ছিল, এটা নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন।
সেদিনের অনুভূতি আমি বলে বোঝাতে পারব না। ধনী, গরিব, ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দল—সবাই এক হয়েছিল। লাখো মানুষের জন্য এটা ছিল শুধুই আনন্দের উপলক্ষ। অনেকে বলতে পারেন, ‘এটা তো শুধু আফকন’। কিন্তু তাঁরা আসলে কিছু জানেন না। আমার কাছে এটা ফ্রান্স, জার্মানি বা ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বাকাপ জেতার চেয়েও বড় অর্জন। ইতিহাসজুড়ে যেখনে হৃদয় ভাঙার গল্প, আবেগ সেখানে অন্য রকম।
অ্যালিউ যেমনটা বলে, ‘যতবার আমরা সেনেগালের হয়ে মাঠে নামি, খেলাটা আর শুধু খেলা থাকে না। আমরা তখন এমন একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করি, অনেকে যে দেশটা সম্পর্কে খুব একটা জানেও না।’
ভাই ও বোনেরা, আমাদের টেবিলে আপনার জন্যও জায়গা আছে। আমাদের সবারই নিজস্ব পতাকা আছে। কিন্তু হৃদয়ের জায়গা নিশ্চয়ই শুধু একজনের জন্য বরাদ্দ নয়।