‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’ ঠেকাবেন কীভাবে

একবার স্ক্রিনের সামনে বসলে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না!
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

পড়ালেখা, চাকরি, বিনোদন থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন স্ক্রিনের ভেতরে ঢুকে গেছে। তরুণ ও যুবকদের মধ্যে এ হার বেশি হলেও বয়স্ক আর শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। এমনকি জন্মের কিছুদিন পর থেকেই শিশুদের দেওয়া হয় ভিডিও ডিভাইস। একসময় স্ক্রিনের প্রতি জন্ম নেয় আসক্তি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য। একবার স্ক্রিনের সামনে বসলে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না! এই যে আমরা এত সময় ধরে এত কাছ থেকে ভিডিও ডিভাইসগুলো ব্যবহার করি, তা থেকে আমাদের চোখের ওপর কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, আসুন জেনে নিই।

দীর্ঘ সময় ধরে ডিজিটাল গ্যাজেট, যেমন কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করলে চোখে দেখা দেয় ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’ নামে পরিচিত একটি সমস্যা। আমাদের চোখের কর্নিয়ার ওপরে পাতলা পানির আস্তরণ থাকে। চোখের পলক ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কর্নিয়ার ওপর যা সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাভাবিক অবস্থায় চোখের পলক ফেলার হার মিনিটে ১২ থেকে ১৫ বার। কিন্তু স্ক্রিন ব্যবহারের সময় আমরা যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে যাই! যার জন্য এই পানির আস্তরণ খুব সহজে শুকিয়ে যায়। শুরু হয় চোখের শুষ্কতা, জ্বালাপোড়া, খচখচে ভাব, ঝাপসা দৃষ্টি।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নিন, সবুজের দিকে তাকান

আবার দীর্ঘ সময় ধরে একই ভঙ্গিমায় শুয়ে বা বসে স্ক্রিন দেখার কারণে ঘাড় ও মাথার পেশি ক্লান্ত হয়ে যায়। যার জন্য হয় মাথা, ঘাড় ও পিঠব্যথা। আরও কিছু কারণ আছে। দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে কাজ করতে হলে আমাদের চোখের পেশিগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হয়। ফলে চোখের পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আরও কিছু প্রভাবক আছে। যেমন কাজের সময় টেবিলে অতিরিক্ত আলো অথবা পর্যাপ্ত আলোর অভাব, চোখের সঙ্গে স্ক্রিনের দূরত্ব ও অবস্থান ঠিক না রাখা, চোখে পাওয়ারের সমস্যা থাকা ইত্যাদি।

আমরা সবাই কমবেশি এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়ে থাকি। কিন্তু বুঝি না কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়। আসুন জেনে নিই।

কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম থেকে উত্তরণ পেতে আমরা সহজ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারি। যেমন ‘রুল অব টোয়েন্টি’। এর অর্থ কাজের সময় প্রতি ২০ মিনিট পরপর অন্তত ২০ ফিট দূরের কোনো কিছুর দিকে ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা। দূরে তাকালে চোখের পেশি শিথিল হয়। ফলে ক্লান্তি দূর হয়। চোখের পলক ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কর্নিয়ার পাতলা পানির আস্তরণ ছড়িয়ে পড়ে। এই পানির মাধ্যমে কর্নিয়া তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ করে, কর্নিয়ার উপরিভাগ মসৃণ হয় এবং দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়।
কাজের ফাঁকে নিয়ম করে ছোট ছোট বিরতি নিতে হবে। এই বিরতিতে একটু হাঁটাচলা করে ঘুরে আসতে হবে। ছোট ব্রেকগুলোয় শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য পানি পান করা যেতে পারে। কামড় বসাতে পারেন আস্ত কোনো ফলে। শরীরের পানির অভাব হওয়া চোখের শুষ্কতার অন্যতম কারণ।

এবার আসি বসার ভঙ্গিমায়। কম্পিউটারে কাজ করার সময় এমনভাবে বসতে হবে যেন চেয়ার আর টেবিলের উচ্চতা হয় সামঞ্জস্যপূর্ণ। চেয়ারে বসলে যেন পায়ের পাতা মাটিকে স্পর্শ করে আর কনুই টেবিলের ওপর সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে রাখা যায়। স্ক্রিনের উচ্চতা হবে এমন যেন মাথা সোজা রেখে ঘাড় উঁচু বা নিচু না করে সরাসরি স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখা যায়। অর্থাৎ স্ক্রিনের ওপরের প্রান্ত হবে চোখ বরাবর বা একটু নিচে। গবেষণায় দেখা গেছে স্ক্রিন থেকে চোখের দূরত্ব হওয়া উচিত ৯০ সেন্টিমিটার। অফিসগুলোয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করার মতো কনভার্টিবেল টেবিল ব্যবহার করতে পারেন, যাতে টেবিলের উচ্চতা বাড়িয়ে দাঁড়ানো উচ্চতার সঙ্গে স্ক্রিন সামঞ্জস্য করে নেওয়া যায়। তাতে একটানা বসে কাজের একঘেয়েমি দূর হবে।

টেবিলের ওপর যথেষ্ট আলো থাকতে হবে। কম আলো ও অতিরিক্ত আলো দুটোই চোখের জন্য খারাপ। স্ক্রিনে গ্লেয়ার (উজ্জ্বল আলোর প্রতিফলন) আসলে ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে। ঘরের আর্দ্রতা বাড়ানোর জন্য হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খেলে চোখের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। চোখের পাওয়ারের সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসক দেখিয়ে সঠিক পাওয়ারের চশমা নিতে হবে।

বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমের শিকার হচ্ছে। এ জন্য শিশুদের স্ক্রিনটাইম নির্ধারিত করে দিতে হবে, যাতে দীর্ঘ মেয়াদে তারা চোখের শুষ্কতা, চোখ বেঁকে যাওয়া, চোখের পাওয়ারের সমস্যা কিংবা অলস চোখের (এমব্লায়োপিয়া) কারণে অন্ধ না হয়ে যায়।


লেখক: সহকারী সার্জন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট