গরমে সবাই একটু হালকা ও নরম কাপড় পরতে ভালোবাসেন। টাইডাই, বাটিক, শিবোরির কাপড় তাই গরমে অনেকেরই প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে। কারণ, এসব পদ্ধতিতে ডাই করার প্রক্রিয়াটাই এমন থাকে যে কাপড়ের জমিন হয়ে ওঠে আরও নরম ও মসৃণ।
টাইডাই, বাটিক, শিবোরি কাপড় রাঙানোর এসব পদ্ধতি মূলত চীন বা জাপান থেকে এসেছে। পরে ভারতবর্ষেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এসব ডাই। সেখান থেকেই আমাদের এখানে জনপ্রিয় হয় টাইডাই, বাটিক ও শিবোরির কাজ।
ডিজাইনার লিপি খন্দকার বলছিলেন, আশির দশক থেকে এই অঞ্চলে টাইডাই জনপ্রিয়। প্রথমেই সুতা দিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে বেঁধে নেওয়া হয়। এরপর রঙে ভিজিয়ে টাইডাই করা হয়। সাধারণত নরসিংদীতে এই টাইডাইয়ের কাজ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বাটিকের কাজে প্রথমেই কাপড়ে মোম দিয়ে নকশা আঁকা হয়। এরপর পুরো কাপড়ে রঙে ভিজিয়ে নেওয়া হয়। শুকিয়ে এলে মোম তুলে ফেললেই তৈরি হয় নতুন নকশার কাপড়। বাংলাদেশে বাটিকের কাপড়ের বাজারে বেশ বড় একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে কুমিল্লার বাটিক। শিবোরির কাজ এখন পোশাকের নকশায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শিবোরি টাইডাইয়ের একটি পরিবর্তিত ধরন। এতে পুরো কাপড়ে যে নকশাটি করবেন, তা নকশিকাঁথার মতো সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। এরপর পুরো কাপড়টির সেই সুতা টেনে বেঁধে নেওয়া হয়। এভাবে বেঁধে রঙে ভিজিয়ে হয় শিবোরির কাজ। পুরো প্রক্রিয়া একটু জটিল। তাই শিবোরির কাপড়ে তৈরি পোশাকের দামটাও একটু বেশি।
কাপড় রাঙানোর এই পদ্ধতি আমাদের এখানে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু জানেন কি, এই টাইডাই আদতে চীনা ও জাপানিদের উদ্ভাবন। তবে ওই সব দেশে যে ধরনের নকশায় টাইডাই করা হয়, আমাদের পদ্ধতি তার থেকে একেবারেই আলাদা। মূলত ভারতবর্ষ থেকে আমাদের এখানে টাইডাইয়ের চল হয়েছে। একসময় ভারতে বাঁধনি কাপড় বেশ জনপ্রিয় হয় ওঠে। বাঁধনির একটি পরিবর্তিত রূপ হলো টাইডাই। ভারতের গুজরাট অঞ্চলে এটি করা হয় বেশি। এই বাঁধনি কাজের একটা ধারা আমাদের টাইডাইয়ে পাওয়া যায়, বলছিলেন ডিজাইনার শৈবাল সাহা।
বাংলাদেশে নরসিংদীতে মূলত এই টাইডাইয়ের কাজ শুরু হয়। নরসিংদীর কাপড়ের কথা তো সবারই জানা। এই এলাকার লোকজন ডাইয়ের কাজে বেশ পটু। টাইডাইয়ের কাজটিও সহজেই ধরে ফেলেন তাঁরা। আস্ত আস্তে টাইডাইয়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে নরসিংদী। এখন অবশ্য অনেক জায়গাতেই এই টাইডাইয়ের কাজ হয়। অনেক নারী উদ্যোক্তা নিজেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতেই টাইডাইয়ের কাজ করে থাকেন।
মোম বাটিকে কাজ করা সুতি পোশাক গরমে বেশ স্বস্তিদায়ক। বাাটিকের গজ কাপড় প্রায় সব মার্কেটেই পাওয়া যায়। কুমিল্লায় মূলত এই বাটিকের কাজ হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যে বাটিকের কাজ হয় তাকে বলে ক্র্যাক বাটিক। মূলত লাঠি বা কাঠি ভেঙে গেলে আঁকাবাঁকা আদল হয়, সেই আদলেই এই বাটিকের নকশা হয়ে থাকে। বাটিকের উৎপত্তিও জাপানে।
জাপানিরা মূলত বইয়ের মলাটে কাপড়ের ব্যবহার করত। সেই কাপড় রাঙাতেই ব্লকের সাহায্যে বাটিকের কাজ করতেন তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গে বাটিক জনপ্রিয় করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশে–বিদেশে ঘুরতেন তিনি। ধারণা করা হয়, বাইরে কোথাও বাটিকের কাজ দেখে শান্তিনিকেতনেও সেটা শুরু করেন। নন্দলাল বসু ও যামিনী রায় বাটিকে যুক্ত করেন আলংকারিক নকশা। শান্তিনিকেতনের বাটিকে প্রাধান্য পায় মূলত আলপনার নকশা, যা সেখানকার বাটিকের কাজকে আলাদা করেছে। এভাবেই এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে বাটিক।
তবে আমাদের এখানকার বাটিকের নকশা একেবারেই ভিন্ন। ইদানীং এখানে মোম বাটিকের পাশাপাশি ব্লক বাটিকের কাজও হচ্ছে।
জাপানি এই কাপড় রাঙানোর পদ্ধতি অনেকটা টাইডাইয়ের মতো। শিবোরিতে এখানে কেমিক্যাল রঙের পাশাপাশি প্রাধান্য পাচ্ছে ভেজিটেবল ডাই, বলছিলেন অরণ্যর ম্যানেজিং অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর নওশিন খায়ের। তাঁদের বেশির ভাগ পোশাকই শিবোরির পদ্ধতিতে রাঙানো হয়।
এ জন্য ব্যবহার হয় গাঁদাফুল, ডালিমের খোসার মতো ফেলে দেওয়া জিনিস। আমাদের এখানে যাঁরা শিবোরি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ডাইয়ের জন্য ভেষজ রঙের ব্যবহার করে থাকেন। এসব উপকরণে তৈরি রঙে শিবোরির কাজ কাপড়কে করে তোলে আরও অভিজাত।