জেন্টেলম্যানস ওয়ার্ডরোব নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা শাবাব দ্বীন শারেক। তিনি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান শপআপের ‘এন্ট্রাপ্রেনিউর ইন রেসিডেন্স’ হিসেবেও যুক্ত আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে অনুলিখন করেছেন এস এম আহসানুস সাকিব
‘পুরুষ-মানুষ একটা কিছু পরলেই হলো।’
‘ছেলে মানুষ, জামা-কাপড় নিয়ে এত চিন্তার কী আছে?’
‘হাতের সামনে যা পাই, তা-ই পরি।’
‘আমি কি মেয়ে-মানুষ নাকি, যে কাপড়-চোপড় নিয়ে ভাবতে হবে?’
‘আমি তো এমনই।’
ছেলেদের পোশাক নিয়ে এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনি। এর কারণ হলো, আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা এবং পুরুষদের পোশাক নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাব। পুরুষেরও যে পোশাকসচেতন হওয়া উচিত, এমন সামাজিক চর্চা খুব একটা চোখে পড়ে না। আর তা ছাড়া যুগ যুগ ধরে চলে আসা ‘পোশাক নয়, কাজেই পরিচয়’ বিশ্বাসও এর জন্য খানিকটা দায়ী। হয়তো একটা আদর্শ পৃথিবীর জন্য এটাই সত্য। কিন্তু আসল সত্য হলো, আমরা একটা আদর্শ পৃথিবীতে বাস করি না। তাই আসুন জেনে নিই, পুরুষদের পোশাকসচেতনতার প্রতি অনীহা তৈরির চারটি কারণ। কেন পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত—এ প্রশ্নেরও চারটি উত্তর থাকছে লেখার শেষে।
পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনীহা কেন
১. পোশাক নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক ধারণা: খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের মধ্যে একধরনের ভুল ধারণা চালু আছে যে সুন্দর করে জামা-কাপড় পরা একধরনের ‘মেয়েলি’ ব্যাপার। এমনকি সব সময় পরিপাটি থাকার ‘অপরাধে’ কখনো কখনো ছেলেদের বুলিংয়ের শিকারও হতে হয়।
২. ভালো বা সুন্দর পোশাক মানেই দামি পোশাক: আমরা ধরেই নিই, ভালো বা সুন্দর পোশাক মানেই দামি, ঝাঁ-চকচকে শোরুম থেকে একগাদা টাকা দিয়ে কেনা পোশাক। আর এ ভুল ধারণা থেকেই আমরা পোশাক কেনার সময় যত্নশীল হই না। অথচ একটু সচেতন আর যত্নশীল হলেই নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যেই এমন পোশাক বেছে নেওয়া যায়, যা আপনার ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের জন্য ‘পারফেক্ট ম্যাচ’।
৩. ভালো বা সুন্দর পোশাক মানেই স্যুট-বুট: পুরুষদের ভালো পোশাক মানেই স্যুটা—ধারণাটা আমাদের একধরনের জাতিগত হীনম্মন্যতা থেকে এসেছে। অবশ্যই গায়ে চমৎকারভাবে এঁটে যাওয়া স্যুট এবং ফরমাল জুতাযুগল আপনাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে, কিন্তু ঠিক তেমনি সচেতনভাবে বেছে নেওয়া পোলো শার্ট, জিনসের প্যান্ট ও ক্যাজুয়াল জুতাও আপনাকে দিতে পারে স্মার্ট লুক।
৪. পরিচর্যা ও অনুশীলনের অভাব: একজন মানুষ কি একদিন জিমে গিয়েই আশা করতে পারে যে সে সুঠামদেহী হয়ে উঠবে? ঠিক তেমনি একদিন একটু সচেতনভাবে পোশাক পরার পর মনমতো চেহারা দেখতে না পেয়ে চেষ্টা ছেড়ে দেওয়াটাও ভুল। শরীরিক গঠনের মতো নিজস্ব স্টাইলের ধারণা গড়ে তোলাও সময়, পরিচর্যা আর অনুশীলনের ব্যাপার। এ ধৈর্যটুকু ধরতে পারি না বলেই আমরা এক-দুবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিই। নিজের সেরাটা আর খুঁজে দেখা হয় না।
পুরুষকে কেন পোশাকসচেতন হতে হবে
১. সুন্দর পোশাকে সুন্দর মন: জামা পরলাম মানেই শরীরে কিছু কাপড় চাপিয়ে নিলাম, ব্যাপারটা তেমন নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, যেদিন আমরা একটু ভালো পোশাক পরি, সেদিন আমাদের আচরণ, আত্মবিশ্বাস, নিজেকে নিয়ে নিজের এবং আশপাশের মানুষের ভালো লাগা আর দশ দিনের চেয়ে একটু আলাদা হয়। সুন্দর কাপড় পরার উদ্দেশ্য শুধু ‘দেখতে সুন্দর লাগা’ নয়, এর সঙ্গে ভালো অনুভব করার একটা যোগসূত্র আছে। যেটাকে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিই না।
২. প্রথমে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারি: সুন্দর, পরিপাটি পোশাক পরা কারও সঙ্গে প্রথম দেখাতেই একধরনের ইতিবাচক ধারণা হয়। অন্যের চোখে নিজের জন্য একটি সম্মানজনক দৃষ্টি যেকোনো জায়গায় ও পরিস্থিতিতে আপনার ভেতর একধরনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসতে সাহায্য করে, যা পরবর্তী সময় ও পরিস্থিতিগুলোকে অনেক সহজ করে দেয়।
৩. সুন্দর পোশাকের সামাজিক মর্যাদা: শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিকভাবেও পোশাকের পরিচয় ও গুরুত্বের সরাসরি একটা সম্পর্ক আছে। সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিফর্মের উদাহরণই ধরা যাক। সামাজিকভাবে এই ইউনিফর্ম সম্মান, শ্রদ্ধা ও কর্তব্যের প্রতীক। এই ইউনিফর্ম সৈনিকদের মধ্যেও একধরনের দৃঢ় মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ইউনিফর্ম তাঁদের কর্তব্যবোধ, প্রতিজ্ঞা, প্রশিক্ষণ মনে করিয়ে দেয়।
৪. সুন্দর পোশাকের মানসিক প্রভাব: সাধারণত আমরা নিজের অজান্তেই নির্দিষ্ট পোশাকের সঙ্গে নির্দিষ্ট ধরনের ব্যক্তিত্বকে মেলানোর চেষ্টা করি। যেমন কারও পোশাক যদি একদম ফিটফাট, পরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত, অনুৎকট হয়; সে যদি চমৎকার রঙের জামা-প্যান্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামা, সঙ্গে স্টাইলিশ জুতা পরেন, আমরা তাঁকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সফল মানুষ হিসেবে ধরে নিই। তাই আমরা নিজেরাও যখন এ ধরনের পোশাক পরি, তখন নিজের অজান্তেই সে রকম আচরণ করতে শুরু করে দিই।
আমরা কী পরছি, কীভাবে পরছি এবং কখন ও কোথায় পরছি, তার ওপর আমাদের সম্পর্কে মানুষ কী ভাবছে ও আমাদের কীভাবে গ্রহণ করছে, তার একটা সরাসরি ও প্রবল যোগসূত্র আছে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের পোশাক আমাদের নিজেদেরও মন, মানসিকতা ও আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে, আশপাশের সবার চোখে আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বাড়িয়ে দেয়।