প্রতিবছর আয়োজনে, ব্যাপ্তিতে, আলোচনায় আগের সব সীমানা অতিক্রম করছে ‘ফ্যাশনের অলিম্পিক’খ্যাত মেট গালা। এ বছর কেবল ইউটিউবে ‘ভোগ’ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত মেট গালার আয়োজন পাঁচ দিনে দেখা হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি বার। গালিচায় তারকাদের বালুর পোশাক, মশারির গাউন, গলায় গয়নার পরিবর্তে হামিংবার্ড, শরীরে জড়ানো আঙুরলতা, লাখো চুমকি–পুঁতি দিয়ে বানানো পোশাক...আলোচনার যেন থামাথামি নেই!
এদিকে গত বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত (১২ মে) ‘দাপ্তরিকভাবে’ প্রকাশিত মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৩৯ হাজার। আহত হয়েছেন অন্তত ৭৮ হাজার ফিলিস্তিনি। অক্টোবরের পর থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার দুটি ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপকূলও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সমুদ্রপথে এই অঞ্চল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব না। গাজার বিমানবন্দর সেই ২০০১ সালেই ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। খোলা ছিল শুধু রাফাহ ক্রসিং। এত দিন রাফাহ ক্রসিং ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের গাজা ছেড়ে যাওয়া এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র স্থলপথ। একে এত দিন গাজার ‘লাইফলাইন’ও বলা হয়েছিল।
নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু হলে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি শহরটিতে আশ্রয় নেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, সেই রাফাহতে চলছে বড় ধরনের ইসরায়েলি হামলা এবং বোমাবর্ষণ। রাফাহর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সবকিছুই করছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফলে রাফাহতে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিরা শহরটি ছেড়ে যেতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু কোথাও যাওয়ার কোনো পথ নেই। শিশুদের নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তাঁরা।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষোভ, আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন থামাতে চলছে পাল্টা রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। প্রতিরোধের মুখে আন্দোলন থেকে থেকে আরও তেতে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় ইভেন্টে দেখা মিলল না সে রকম কোনো প্রতিবাদ বা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতার বার্তা।
এই প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাজ্যের ‘ফ্যাশনসৈনিক’ ভেনেটিয়া লা মানা ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তিনি জানান, ফ্যাশন সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। ফ্যাশন তো শিল্প। আর শিল্প কীভাবে অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ হয়? ফ্যাশন, পোশাক, বুনন—সবই রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৩৪ বছর বয়সী এই ফ্যাশন সমালোচক এ বছরের মেট গালার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘আমাদের “প্রিয়” তারকারা এমন সব পোশাক পরেছেন যে সেসব পরে তাঁরা নড়াচড়া তো দূরের কথা, শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছেন না। এদিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজার রাফাহ সীমান্তে ঢুকে পড়ে হামলা চালাচ্ছে। ওখানকার ফিলিস্তিনিদের নিরাপদে সরে যাওয়ার কোনো রাস্তাই খোলা নেই। তাঁরাও নড়াচড়া করতে বা শ্বাস নিতে পারছেন না!’
এর আগে কোনো মেট গালা বা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন উৎসব কখনোই এতটা অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ, ম্যাড়মেড়ে ছিল না। ২০২১ সালে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মানবাধিকারকর্মী, ৩৪ বছর বয়সী আলেকজান্দ্রিয়া ওক্যাসিও–কর্টেজ মেট গালায় একটা সাদা গাউনে দেখা দেন। যার ওপর লাল অক্ষরে লেখা ছিল, ‘ট্যাক্স দ্য রিচ’। ২০১৮ সালের মেট গালায় মার্কিন অভিনেত্রী ও প্রযোজক লিনা ওয়েথ একটা রেইনবো কেপে দেখা দেন। ২০২২ সালে ব্রিটিশ অভিনেতা ও র্যাপার রিজ আহমেদের পোশাকে উঠে আসে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়নে, আধুনিকীকরণে অভিবাসীদের ভূমিকা।
মেট গালায় একজন তারকার ওপর তাক করা থাকে কয়েক হাজার ক্যামেরা। লাখো মানুষের চোখ থাকে তাঁদের ওপর। মেট গালার লালগালিচা ফ্যাশনের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম সেরা সুযোগ। কিন্তু এ বছর ইসরায়েলি হামলার এই ভয়ংকর বাস্তবতার সময়ে দাঁড়িয়েও কাউকে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
অথচ এর আগে যখন ‘মি টু মুভমেন্ট’ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী, ২০১৮ সালে গোল্ডেন গ্লোবের মঞ্চে অনেকেই সেই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন ফ্যাশনের মধ্য দিয়ে। রিজ উইদারস্পুন, এমা স্টোন থেকে শুরু করে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, মরগ্যান ফ্রিম্যান, লরা ডার্ন, অ্যাশলে জুড, লেডি গাগা, সালমা হায়েকসহ অনেকেই লালগালিচায় ফ্যাশনের মধ্য দিয়ে যৌন নির্যাতনের বিপক্ষে পরিষ্কারভাবে তাঁদের অবস্থান জানান দিয়েছেন। অনেকের হাতেই দেখা গেছে ‘টাইম’স আপ’ ব্রেসলেট ও রিবন। যেটি কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তা দেয়। ২০২২ সালেও মাইকেল ডগলাস, গ্রেটা লিসহ অনেকেই স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ডের লালগালিচায় হলুদ–সবুজ পিন পরে এসে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের পক্ষে নিজেদের সমর্থন জানান।
চলতি বছর অস্কারের লালগালিচায়ও মার্কিন সংগীততারকা বিলি আইলিশ, মিসরীয়-মার্কিন অভিনেতা রামি ইউসুফসহ অনেকেই ‘আর্টিস্ট ফর সিজফায়ার’ পিনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানান। অনেক তারকার পোশাকের বোতাম ছিল ফিলিস্তিনের পতাকার রঙে তৈরি। এভাবেও তাঁরা ফ্যাশনের ছোট্ট অনুষঙ্গের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন। তবে এবারের মেট গালায় একটা হাতব্যাগের রং, জুতা, কানের দুল, হাতমোজা বা জামার বোতামেও দেখা যায়নি তরমুজের (ফিলিস্তিনের পতাকার রং লাল, সবুজ, সাদা, কালো—এ কারণে তরমুজকে প্রতীক হিসেবে ধরা হয়) রং!
এ বছর মেট গালায় ফ্যাশনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য বা অবস্থান উঠে না আসার পেছনের রাজনীতি কী হতে পারে? এই বীভৎস নীরবতার পেছনে অনেক ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করেছে বলে মনে করেন লা মানা। তিনি বলেন, ‘এখানে তো ব্যক্তিগতভাবে কেউ অংশ নেয় না। সবাই অংশ নেয় হয় কোনো ফ্যাশন বা বিউটি ব্র্যান্ডের হয়ে, অথবা আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (যেখানে আন্দোলন চলছে) অন্দোলনে পুলিশি আক্রমণের ফলে একধরনের জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাই অনেকেই বিউটি ব্র্যান্ডগুলোকে সব রকম বিতর্কের বাইরে রাখতে চান। কেননা, তাঁরা ব্র্যান্ডেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। কে নিজেদের আয়ের একটা খাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে? পরের বার আমন্ত্রণ না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে? সেই সৎ সাহস, মেরুদণ্ড কারও নেই। এই অবস্থা নিশ্চিতভাবেই নৈতিকতার সামগ্রিক অধঃপতন। সবাই এখানে নিজে নিরাপদ থেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।’
১৯৮৮ সাল থেকে ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন অ্যানা উইন্টোর। ২০২২ সালে তাঁর জীবনী ‘অ্যানা: দ্য বায়োগ্রাফি’ লিখে সাড়া ফেলে দেন লেখক, সাংবাদিক অ্যামি ওডেল। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে যা ঘটছে, মেট গালাকে তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটা আয়োজন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অথচ সেখানে চারপাশে যা ঘটছে, তার কোনো প্রতিফলন না থাকা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এবারের মেট গালার থিম ছিল “গার্ডেন অব টাইম”। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সাদা, সবুজ, লাল রং প্রাধান্য পাবে। আর কালো তো চিরকালীন ক্ল্যাসিক, ফ্যাশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় রং। আশা করেছিলাম, এবার হয়তো (ফিলিস্তিনের পক্ষে) সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া যাবে। যা ঘটল, এটা খুবই হতাশার। এই মুহূর্তে সাহসহীনতার এর চেয়ে মোক্ষম উদাহরণ আর হয় না। ব্যাখ্যা, যুক্তি, বিবৃতি দিয়ে দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।’
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান